ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বারবার বস্তিতে কেন আগুন

সাহাদাৎ রানা
🕐 ৬:৪২ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৯, ২০২০

বস্তিতে আগুন। রাজধানীতে কয়েক মাস পরপর যেন একটি পরিচিত চিত্র। যে চিত্র দেখে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে নগরবাসী। কিন্তু এমন আগুন দরিদ্র মানুষের জন্য কতটা ভয়াবহ তা আমরা কেউ ভেবেও দেখি না। তবে আগুন লাগার পর সেই আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে কয়েকদিন আলোচনা হয় সত্যি। এক বা একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়। এরপর সব আগের মতো হয়ে যায়। আগুন নেভার পর যেন সবার আলোচনাও নিভে যায়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, এভাবে আর কত দিন। কতবার বস্তিতে আগুন লাগার পর তবে বস্তিতে আর আগুন লাগবে না।

এমন প্রশ্ন উঠছে এ কারণে, প্রতিবার আগুন লাগার পর আগুন লাগার উৎস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কেউ বস্তি উচ্ছেদ করার জন্য আগুন ইচ্ছে করে লাগিয়েছে এমন অভিযোগ ওঠে সবার আগে। এ বিষয়ে কিছু যুক্তি তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি মিরপুরের রূপনগরে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যে আগুনে ক্ষতি হয়েছে অনেক। আগুনে পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে পুড়ে গেছে হতদরিদ্র মানুষের ছোট ছোট সহস্র স্বপ্ন। যে স্বপ্নগুলো তাদের আবারও নির্মাণ করতে হবে হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে। যে খাটুনির মূল্য দিতে অনেকে ব্যর্থ হয়ে জীবন লড়াইয়ে পরাজিত হবেন। কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখি না বস্তির হতদরিদ্র মানুষের যে ক্ষতি হল তা কীভাবে পূরণ করা হবে।

বাস্তবতা হল, আমাদের এ নগরীতে ছোট বড় অসংখ্য বস্তি রয়েছে। ব্যস্ত নগরীর বস্তির চারপাশে রয়েছে আকাশ ছোঁয়া ভবন। যে ভবনে বসবাস উচ্চবিত্তের। আর এর মাঝখানে হাজার হাজার প্রাণের বসবাস। যখন আগুন লাগে সেই আকাশ ছোঁয়া ভবন থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়ার ভয়ানক চিত্র দেখা সত্যিই কঠিন কাজ। সেই কঠিন কাজটাই যেন মাঝে মাঝে করে যাছে নগরবাসী। কিন্তু কোনো প্রতিকার আর হয় না। বন্ধ হয় না আগুন লাগা। অথচ, আমরা ভেবেও দেখি না, শত অপ্রাপ্তির মধ্যেও ব্যস্ত নগরীতে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন এ বস্তি। সেই আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান তারা। এখানে সবচেয়ে হতাশার খবর হল- বস্তিতে মাঝেমধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। সময়ের সঙ্গে লড়াই করে কখনো কখনো তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখও দেখে। বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করে তদন্ত কমিটি সুপারিশসহ রিপোর্ট দিলেও সেই সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ বিষয়ে আশ্বাস থাকে সবসময়। সেই আশ্বাসকে বিশ্বাস করে দিন গোনে অসহায় মানুষ। এটা শুধু বস্তিতে আগুন লাগার ক্ষেত্রে নয়। প্রায় সব আগুনের ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অবশ্য বস্তিতে আগুন লাগলে সবার আগে অনেকে মনে করেন বস্তি উচ্ছেদ করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে। হাজার হাজার বস্তিবাসীকে স্থানচ্যুত করার এটি একটি কৌশল। এমন অভিযোগ সবসময় সত্যি নয়। অনেক সময় নানা যৌক্তিক কারণে আগুন লাগে।

রাজধানীর বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে আমাদের অভিজ্ঞতায়। আমাদের অভিজ্ঞতা আরও করুণ এ কারণে, একটি শ্রেণি সবসময় এসব বস্তিবাসীকে পুনর্বাসনের জন্য নানা কথা বলেন। কিন্তু কাজের কাজ আর কিছুই হয় না। বরং একটি শ্রেণি অপেক্ষায় থাকেন কীভাবে বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করে জায়গা দখল করা যায়। এটা সত্যি, যে বস্তিবাসী প্রকৃতপক্ষে সেই জায়গার মালিক নন। তারা নিরুপায় হয়ে এসব জায়গায় অতি কষ্টে বসবাস করেন। দেখা যায়, বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে প্রধানত রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী, বিভিন্ন বাসার গৃহকর্মী, সবজি বিক্রেতা ও ভাসমান হকাররা রয়েছেন। পরিতাপের বিষয় আগুনে এসব বস্তিবাসী শুধু আশ্রয়ই হারায় না, পাশাপাশি তাদের সংসারের যাবতীয় সামগ্রী ও সম্পদ হারিয়ে পথের ফকির হন। তাই তাদের নিয়ে যেন ভাবার সময় নেই কারও। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগুন নেভানোর বিষয়ে সফলতা রয়েছে আমাদের। তবে বস্তিতে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সফলতা খুব কম। বেশির ভাগ সময় দেখা গেছে বস্তির সব কিছু পুড়ে যাওয়ার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য বস্তির ঘনবসতি অনেকাংশে দায়ী।

এখানে একটি তথ্য অপ্রিয় হলেও সত্যি। আমাদের সমাজে কিছু লোক রয়েছে যারা বস্তিবাসীদের নিয়ে ব্যবসা করেন। কারণ এসব বস্তিবাসীকে স্থানীয় চাঁদাবাজদের চাঁদা দিয়ে থাকতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া। বস্তিতে যারা থাকেন তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে অনেক অভিযোগ। মাদক বিক্রির অন্যতম নিরাপদ জায়গা বস্তি। এমন অভিযোগের সত্যতাও রয়েছে। কিছু বস্তিবাসী বস্তিতে থেকে মাদক ব্যবসা করেন। আবার চোর ও ছিনতাইকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ের জায়গাও বস্তি। কিন্তু এর জন্য তারা আগুনে পুড়ে মারা যাবেন এটাও কাম্য নয়। যারা অপরাধী তাদের ধরে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কিন্তু বস্তি পুড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সমাধান নয়!

তবে এখন সময় এসেছে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবার। কেননা, নগরীতে অসংখ্য ছোট বড় বস্তি রয়েছে। যেখানে বসবাস করেন কয়েক লক্ষ মানুষ। আগুন লাগলে বস্তিবাসী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এখন তাদের ক্ষতির বিষয়টি ভাবতে হবে। নানা কারণে আগুন লাগতে পারে। তবে আগুন লাগলেও যেন ক্ষতিগ্রস্তদের কথা ভাবা হয়। বিশেষ করে সবার আগে ভাবতে হবে তাদের পুনর্বাসনের কথাটি। দরিদ্র ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়া এসব বস্তিবাসীর জন্য সরকার ও বিত্তবানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, নগরীতে এত শ্রমজীবী মানুষকে আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। তাদের শ্রমও আমাদের অনেকের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাই এখন শহরের অপরিহার্য হয়ে উঠা এসব শ্রমজীবী মানুষের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবি। এবং নাগরিকদের সময়ের প্রয়োজনও। সময়ের হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বস্তিবাসীকে পুর্নবাসনের কথা শোনা যাচ্ছে। স্বল্প আয়ের এ সব মানুষের আবাসন সমস্যার সমাধানে সব সময়ই সরকার ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সেই আশ্বাস আর বাস্তবায়ন হয় না। তবে এখন আর বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। এখন বস্তিবাসীর সার্বিক জীবনমানের উন্নয়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কেননা, বস্তিতে আগুনে পুড়ে হাজার হাজার পরিবার আশ্রয়হীন ও সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার পর তাৎক্ষণিক কিছু সাহায্য দেওয়া হয় সত্যি, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগ আর নেওয়া হয় না। যা নেওয়ার সবার আগে প্রয়োজন। পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। তবেই আর বস্তিতে বারবার আগুন লাগবে না। আর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না এ বিষয়ে।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

 
Electronic Paper