বইমেলা হোক বিশ্বমুখী
এম. জুবায়ের হোসেন
🕐 ৮:৩৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০
পরোক্ষভাবে হলেও সব কিছুরই একটা বাহ্যিক রূপ আছে। বাঙালির জ্ঞানের বাহ্যিক রূপ হল বইমেলা। আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারে ‘যদ্যপি আমার গুরু’বইয়ে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, কোন এলাকার মানুষ কেমন বা কতটুকু জ্ঞানী তা বোঝা যায় ঐ এলাকার লাইব্রেরির বই দেখে।
সঙ্গত কারণেই বইমেলাকে শুধু বিকিকিনির মেলা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। বইমেলা হলো বাঙালির জ্ঞানের প্রতিচ্ছবি। আগামী প্রজন্মের জেগে ওঠার সম্ভাবনা, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, নারীর ক্ষমতায়ন, গবেষণা, জাতীয়তা, মানবতা, রাজনীতি, বিজ্ঞান সব কিছুরই একটা ক্ষুদ্র প্রতিবিম্ব হলো এ মেলা। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই, নেই জাত ধর্মও। তাই এ মেলাকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশে^র আনাচে-কানাচে।
বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছি কিন্তু আমরা কি বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক দরবারে পৌঁছাতে পেরেছি? বইমেলাকে বিশ্বমুখী করা গেলে অতি সহজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ববাসী চর্চা করতে বাধ্য হবে। বিশ্বগ্রামের যুগে বাংলাদেশের প্রায় সব উৎসব এবং মেলাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হয় শুধু বইমেলাটাই জাতীয় রয়ে গেল। ফোক ফেস্ট, লিট ফেস্ট ও ফিল্ম ফেস্ট সবগুলোতেই প্রকৃত আন্তর্জাতিক রূপরেখার দেখা মিলে শুধু বইমেলাটা ছাড়া।
আমরা যদি কলকাতা বইমেলার দিকে তাকাই এটিকে অনেক জরিপে বিশ্বের তৃতীয় বইমেলা হিসেবে ধরা হয়। এ মেলায় প্রতি বছরই একটি বিদেশি দেশকে থিম কান্ট্রি হিসেবে রাখা হয়। এ বছরও ২৯ জানুয়ারি উদ্বোধন হওয়া বইমেলাতে থিম কান্ট্রি ছিল রাশিয়া। প্রতিদিনই ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রখ্যাত লেখক, প্রকাশক ও দর্শকদের অংশগ্রহণ ঘটেছে। কলকাতার সাহিত্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, আমেরিকাতেও।
এ জন্যই ইন্ডিয়াতে আন্তর্জাতিক মানের বড় বড় সাহিত্যিক সৃষ্টি হচ্ছে এবং ইন্ডিয়ার ভাষা ও সাহিত্য ঘষা-মাজা হচ্ছে বিশ^ব্যাপী। একুশে বইমেলার প্রাচীন চিন্তার আয়োজন থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বইমেলার আয়োজন করা বাংলা একাডেমির কাজ ও উদ্দেশ্য কোনোটাই নয়। এ মেলা করার মতো অতীতে আমাদের শক্তি ছিল না বলে ঠেকায় পড়ে এ কাজ বাংলা একাডেমির কাঁধে পড়ে গিয়েছিল। এ ঠেকায় পড়া আয়োজন বাদ দিয়ে সময়োপযোগী মেলার আয়োজন করতে হবে।
আমরা যদি বিশ্বের বড় বড় বইমেলাগুলোর দিকে তাকাই এবং কলকাতার বইমেলার দিকে তাকাই তাহলে সবগুলোর আয়োজকই হলো লেখক-প্রকাশকরা বা প্রকাশনা সংস্থা। একুশে বইমেলার ক্ষেত্রেও তাই করা অপরিহার্য। বইমেলার আয়োজকরা সারা বছর শুধু বইমেলা নিয়েই কাজ করবেন, ভাববেন। কিন্তু বাংলাদেশের লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে মেলার আয়োজক পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই গলদ আছে বিস্তর।
ভাবতে হবে লেখক-প্রকাশকের কাজের মান এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়েও। সারা জীবন জ্ঞানের পেছনে ব্যয় করে ভিক্ষা করে যেন চিকিৎসা চালাতে না হয়, অনাহারে যেন মারা না যায়। বই কিনতে গিয়ে স্টল আর বই খুঁজতে খুঁজতে মানুষ যেন হয়রান না হয়। স্টল খোঁজা, পছন্দের বই খুঁজে পাওয়ার জন্য ভালো এ্যাপস তৈরি করা যেতে পারে। একটু বৃষ্টি হলেই যেন ষোল কোটি মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি পানিতে না ভাসে।
অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা মাথায় রেখেই স্টল স্থাপন করতে হবে। প্রচার না, লেখক-প্রকাশকের হকারি বন্ধ করতে হবে। লেখকের লেখার মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, ঠিক তেমনি প্রশ্ন আছে প্রকাশকের অর্থ বিনিয়োগের পুঁজি বা জ্ঞানের পুঁজি নিয়েও। তড়িগড়ি করে কোনো রকমে একটা বই ছাপিয়ে লেখক হয়ে সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জন করা মূল লক্ষ্য অধিকাংশেরই। অবশ্যই সবাইকে লেখক হতে হবে না, তবে পাঠক হতেই হবে।
বইপড়া বা প্রকাশ করা যেন ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। মাসব্যাপী ব্যস্ত ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বইমেলা করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত গভীর ভাবনার বিষয়! প্রকাশক ও দর্শকের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা হলো জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের যা অনুষ্ঠিত হয় মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। এতে অংশগ্রহণ করে ১১০টি দেশেরও বেশি লোক। বিশ্ববিখ্যাত লন্ডন বইমেলা হয় সাত দিন ধরে। ইতালির তুরিন বইমেলা হয় পাঁচ দিন ধরে, আমাদের পাশর্^বর্তী কলকাতার বইমেলা হয় দশ-বারো দিনব্যাপী। জগৎবিখ্যাত মেলাগুলো অল্পদিনব্যাপীই আয়োজন করা হয়।
এতে করে মেলার খরচ, সৌন্দর্য, নিরাপত্তা, আকর্ষণ সবকিছুই ঠিক রাখা যায়। তবে যেহেতু একুশে বইমেলাকে বাংলা ভাষার উৎসব বলা হয় সেহেতু আমরা বছরে দুইটি মেলা করতে পারি। পাঁচদিন জাতীয় বইমেলা আর পাঁচদিন আন্তর্জাতিক বইমেলা। একমাস ধরে মেলা করলে যাদের অংশগ্রহণ ঘটবে, পাঁচ দিন ধরে করলেও যে খুব কম হবে তা নয় কিন্তু।
বইমেলাকে বিশ্বমুখী করা গেলে মেলার সৌন্দর্য, নিরাপত্তা, গ্রহণযোগ্যতা, প্রচারণা ও লেখক-প্রকাশকের মান ও হবে বিশ্বমানের। মেলার উদ্বোধনী দিনে দেশীয় খ্যাতিমান লোকদের সঙ্গে বিদেশি লেখক ও প্রকাশক দ্বারা মেলা উদ্বোধন করা গেলে দেশি সাহিত্যের সেতুবন্ধন ঘটবে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে। বুদ্ধিজীবী, আমলা, এমপি-মন্ত্রীসহ সমাজের উঁচুস্তরের লোকদের নিয়মিত পদচারণা ঘটবে মেলায়। প্রতিদিন বইমেলায় দেশি-বিদেশি বিখ্যাত ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ঘটলে নতুন প্রজন্ম লেখালেখির প্রতি আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। জ্ঞান সংক্রান্ত কাজগুলো হবে আন্তর্জাতিক মান চিন্তা করে। বইয়ের প্রচ্ছদ, লেখার মানে আসবে বিশাল পরিবর্তন।
দূর হবে বিশ্ববাসীর নেতিবাচক ধারণা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি জাতি সম্পর্কে। এভাবেই হতে পারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমুখী করার একটা যুগোপযোগী প্রক্রিয়া। বইমেলা বিশ্বমুখী করার জন্য সরকার, বুদ্বিজীবী, লেখক, প্রকাশক, প্রচারমাধ্যমসহ জ্ঞানপ্রেমীদের মনে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
এম. জুবায়ের হোসেন : শিক্ষক ও গবেষক