শিক্ষিত মায়ের গুরুত্ব
এম মনসুর আলী
🕐 ৮:২৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০
যে পরিবারে মা সুশিক্ষিত সে পরিবারের ছেলেমেয়ে নিরানব্বই ভাগই শিক্ষিত। একজন সুশিক্ষিত জননীই পারেন দেশকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাকে একটি শিক্ষিত জাতি দেব। নেপোলিয়নের বাণীটি চিরন্তন সত্য।
দেশকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে সুশিক্ষিত মায়ের বিকল্প নেই। মা তো মাঠের জমির মতো। যেমন জমি তৈরি হবে, ফসলও ঠিক তেমনি হবে। দীন মানসিকতা, মন্দ রুচির মায়ের পেটের ছেলে-পেলেও মন্দ রুচির হবে। একজন মা তার সন্তানকে যে আদর্শে শিক্ষা দেবেন, বড় হয়ে ওই সন্তান সেভাবে জীবনযাপন করবে। আমি দুইটি গল্পের মাধ্যমে শিক্ষিত জাতি বা আদর্শ পরিবার গঠনে সুশিক্ষিত জননীর প্রয়োজনতা তুলে ধরছি।
গল্প ১ : পিতৃহারা ৭-৮ বছর বয়সী একটি ছেলে স্কুল থেকে বাড়িতে এসে মাকে বলল, ‘হেড স্যার আমাকে আদর করে কিছু ক্যান্ডি দিয়েছেন আর তোমাকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি দিয়েছেন।’মা ছেলের হাত থেকে নীল খামের চিঠিটা হাতে নিয়ে খুলে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। ছেলেটি বলল, কাঁদছ কেন! মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, এটা আনন্দের কান্না। তোমাকে চিঠিটা পড়ে শোনাই
শ্রদ্ধেয়, আপনার ছেলেটি সাংঘাতিক জিনিয়াস। ছোট্ট শহরে ওকে পড়ানোর মতো শিক্ষক আমাদের স্কুলে নেই। তাই যদি পারেন আপনার ছেলেকে বড় শহরে কোনো স্কুলে ভর্তি করে দিন। ছেলেটি একদিন বিশ্বে প্রচুর সুনাম অর্জন করবে। চিঠি পড়া শেষে মা ছেলেটিকে চুমু দিয়ে বললেন, জিনিয়াস ছেলেটিকে আমিই পড়াব!
এ সুশিক্ষিত মা নিজেই শিক্ষা দিয়ে ছেলেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বানিয়েছিলেন। তিনি বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। অনেক বছর পরের কথা। মায়ের মৃত্যর পর টমাস আলভা এডিসন একদিন মায়ের সেই ছোট্ট বাড়িতে গিয়ে ঘর পরিষ্কারের সময় একটি পুরাতন বইয়ের ভেতর স্কুলের হেড মাস্টারের চিঠিটা পেলেন। তাতে লেখা ম্যাডাম, আপনার ছেলে টমাস আলভা এডিসন একজন মেন্টাল রিটার্ডেড।
সে এতটাই নির্বোধ, তাকে শিক্ষা দেওয়ার মতো ক্ষমতা ও সময় আমাদের কাছে নেই। কারও আছে বলে জানা নেই। আপনার ছেলের কারণে আমাদের স্কুলে সুনাম ক্ষুন্ন হবে। তাই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আপনার ছেলেকে স্কুল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হলো।
গল্প ২ : গল্পটি আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। রমজান আলী। ছেলেটি ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিল। অভাবের সংসার। বাবার থাকার ভিটেটা ছাড়া সহায় সম্বল বলতে আর কিছুই নেই। মা একমাত্র সন্তান রমজানকে খুবই আদর করতেন। অন্যায় করলেও মা তাকে কখনো বকাবকি করতেন না। একদিন শিশু রমজান এক সহপাঠির পেন্সিল চুরি করে এনে মাকে দেখাল। মা তাকে বকাঝকা না করে প্রশংসাই করলেন।
ছেলেটি আর একবার তার কোনো বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা ভালো জামা চুরি করে আনল। মা এবারও তার প্রশংসা করলেন। এভাবে বড় হওয়ার পর ছেলেটি চুরি ছেড়ে ডাকাতি করতে লাগল। একদিন ডাকাতি করতে গিয়ে কয়েকজন মানুষ মারল সে। একসময় এলাকার ত্রাস হয়ে গেলে তার নামে ডজন খানেক মামলা হল থানায়। পুলিশ তাকে দিন রাত খুঁজছে। হঠাৎ একদিন রমজান পুলিশের হাতে ধরা পড়ল।
তার চুরি, ডাকাতি ও হত্যা মামলার বিচার হলো আদালতে। বিচারক প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে একজন জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো সাধ আছে? রমজান বলল, মাকে দেখতে চাই।
পরদিন মাকে ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা করার জন্য আনা হলো। ছেলেটি তার পাশে কাঁদতে থাকা মায়ের কানে কানে কথা বলতে চেয়ে কানের লতি কামড়ে ছিঁড়ে ফেলল। তারপর বলল, তুমিই আমার প্রাণদণ্ডের কারণ। প্রথম যেদিন পেন্সিল চুরি করেছিলাম সেদিন তুমি যদি আমাকে শাসন করতে তাহলে আমাকে এভাবে মরতে হতো না। অধঃপতনের জন্য তুমিই দায়ী।
উপরোক্ত দুটি গল্পের মাধ্যমে বোঝা গেল একজন সুশিক্ষিত মা-ই পারেন সন্তানকে যথার্থ মানুষ করতে। সুশিক্ষিত মা যে শিক্ষিত জাতি গঠনে প্রধান সহায়ক তার একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। আমাদের পাশের পাড়ার প্রয়াত শিক্ষক আসমত আলী (ছদ্মনাম) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শেষ বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করে ঘরে আনেন সাহেনা নামে একজন সুশিক্ষিত মেয়েকে। সাহেনা বেগমের একমাত্র ছেলে ইকবাল হোসেন একজন ইঞ্জিনিয়ার।
ইকবালের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পেছনে সব অবদান সাহেনা বেগমের। পক্ষান্তরে আসমত আলীর প্রথম স্ত্রী খাদিজা বেগমের ঔরসজাত দুই সন্তান রাকিব ও নাজমা কোনো রকমে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। চরিত্রেও তাদের কলঙ্ক আছে।
এবার পরিচিত একজন জমিদারের পারিবারিক কাহিনী বলছি। নাম কেরামত আলী ভুইয়া (ছদ্মনাম)। জীবদ্দশায় পাঁচটি বিয়ে করেন তিনি। এদের মধ্যে তিনজন স্ত্রী ছিলেন স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত। তাদের ছেলেমেয়েরা সবাই সুশিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিত। অপরপক্ষে কেরামত আলীর বাকি দুই স্ত্রী ছিলেন অশিক্ষিত। এ দুই স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা সবাই অল্প ও অশিক্ষিত। এরকম বাস্তব উদাহরণই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে জাতিকে শিক্ষিত করতে হলে শিক্ষিত মায়ের বিকল্প নাই।
অশিক্ষিত মায়েরা অজ্ঞতার কারণে সন্তানের জীবন গঠনে খুব একটা সহায়তা করতে পারে না। সব ক্ষেত্রেই শিক্ষিত মায়ের উপস্থিতি সন্তানের জীবনে পূর্ণতা আনে। একজন শিক্ষিত মা-ই পারেন সন্তানের সুপ্ত মনোবৃত্তির বিকাশ ঘটিয়ে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিতে।
এম মনসুর আলী : কলাম লেখক