ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পলিথিন ও পরিবেশ

মোশারফ হোসেন
🕐 ৮:১১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২০

প্লাস্টিক বা পলিথিন তৈরিতে কয়লা ও অশোধিত তেল থেকে প্রাপ্ত গ্যাস ও তরল বস্তু দ্বারা উৎপাদিত হয়। আর এ গ্যাস ও তরল বস্তুর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু। তাপ ও চাপের ফলে জোড়া লেগে থাকে বিদ্যমান অণুর বিশাল শিকল বা চেইন। একেই পলিমার বলে।

পলিমার নমনীয় বলেই যে কোনো আকার-আকৃতি দেওয়া যায়। এভাবেই তৈরি হয় প্লাস্টিক বা পলিথিন। ব্যবহৃত প্লাস্টিক মাটির সঙ্গে অথবা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে সাড়ে চার শ’ বছরেরও বেশি সময় লাগে। সূর্যের তাপ, আর্দ্রতা, আবহাওয়া, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পলিথিনকে নষ্ট করতে পারে না। বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্ক সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার এবং অন্যান্য দ্রাবক পদার্থের সমন্বয়ে প্রথম প্লাস্টিক তৈরি করেন ১৮৮৫ সালে।

প্লাস্টিক ও পলিথিনের কিছু সুবিধা থাকলেও এর মারাত্মক ক্ষতির পরিমাণই বেশি। প্লাস্টিক পলিথিন পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশকে নষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। প্লাস্টিক বর্জ্য ও পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিকার প্রভাব পড়ছে উদ্ভিদকুল জলজ প্রাণী এবং মানবজাতির উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। আমাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত একটি বিরাট অংশজুড়ে প্লাস্টিকের দখল। বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে ৩৩,৮০০টি প্লাস্টিকের বোতল এবং ব্যাগ সাগরে গিয়ে পড়ছে।

বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ টন। ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে মিশবে। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন মারফত জানা যায়, বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণে বাংলাদেশ দশম। আমাদের দেশের বর্জ্যরে প্রায় ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক।

এক জরিপে জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৫২ লাখের বেশি পলিথিন আবর্জনা হিসেবে জমা হচ্ছে। বছরের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৮০ কোটি পলিথিন। ঢাকা শহরে বৃষ্টি মৌসুমে জলবদ্ধতার জন্য অনেকাংশে দায়ী প্লাস্টিক ও পলিথিন। দীর্ঘ মেয়াদে জমে থাকার কারণে অস্বাস্থ্যকর, দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে মশার অভয়াশ্রম তৈরি হয়। বিভিন্ন জলবাহিত রোগের সৃষ্টি হয়।

এক্ষেত্রে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার জন্য পলিথিনকে অনেকাংশে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞ মহল। বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক-পলিথিনের বর্জ্যগুলোতে বিদ্যমান উগ্র রাসায়নিক পদার্থ পানি, বায়ু ও মাটিকে নানাভাবে দূষিত করে থাকে। মাটিতে দ্রুত পচনশীল না হওয়ার কারণে মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট, ভূগর্ভের পানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়াও সাগর দূষণের মতো মারাত্মক আকারের বাস্তুতন্ত্রে বিঘ্নিত হচ্ছে।

এতে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বিপন্নের বিষয়টি খুব লক্ষণীয়। ওয়ার্ল্ড এ্যানিমেল প্রোটেকশনের সূত্র থেকে জানা যায়, সাগরে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিক খাচ্ছে সাগর প্রাণীকুল। তাদের রোগের সৃষ্টি হচ্ছে এর থেকে। ‘নারডল’নামক শিল্পজাত প্লাস্টিক যা প্লাস্টিক পণ্য কার্গোশিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ জাতীয় প্লাস্টিক থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন বায়োস ফেনল, পলিস্টিরিন ইত্যাদি নির্গত হয়ে সাগর পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করে।

অন্য আর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সমুদ্রের পানিতে ৫ ট্রিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ভাষ্যানুযায়ী আমরা দেশের বেশিরভাগ নাগরিক পলিথিন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানি। পলিথিন ব্যবহারের নিষিদ্ধ দেশ হিসেবে বাংলাদেশই প্রথম। কিন্তু এরপরও পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার আগের তুলনায় না কমে বরং কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

সমীক্ষা থেকে জানা যায় প্রতি কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ২-৩ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়।  প্রতি বছর প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে প্রায় ১৭০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়। এসবকিছুই জলবায়ুর পরিবর্তনে নেতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতেও প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমেরিকাতে প্রতি বছর প্রায় ৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয়।

এর মধ্যে মাত্র প্রায় ২৪ শতাংশ পুনঃচক্রায়ন হয়ে থাকে। বাকি প্রায় ৩.৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আকারে ফেলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সালে যেখানে প্রতিদিন বাংলাদেশের প্রায় ৬৫০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হতো ২০২৫ সালে সেখানে প্রতিদিন হিসেবে প্রায় দাঁড়াবে ৫০,০০০ টন। ২০১৫ সালের অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানাযায় শঙ্খচিলসহ সামুদ্রিক পাখি প্রায় ৯০ শতাংশের পাকস্থলিতে প্লাস্টিক রয়েছে।

 ২০১২ সালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, সমগ্র বিশ্বের সমুদ্রে আনুমানিক ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য আছে। পুড়ে যাওয়া পলিথিন থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস মানব দেহের শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসে মারাত্মক সমস্যা, চর্মরোগ, ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি হয়ে থাকে।

প্রসাধনী রাখার পাত্র, পানির পাইপ, খেলনা, গৃহসজ্জার বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ইত্যাদি পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি প্লাস্টিক পদার্থ দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে জন্মগত ত্রুটি, জেনেটিক পরিবর্তন, আলসার, ব্রংকাইটিস, শুক্রাণু সংখ্যা হ্রাস, লিভার সমস্যা, হরমোন পরিবর্তন, হাঁপানির মতো জটিল জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দেশ সচেতন হচ্ছে।

সম্প্রতি তিউনিসিয়া ২০২১ সালের মধ্যে সব ধরনের প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে। সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ রোধকল্পে ইন্দোনেশিয়া ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য কমানোর পরিকল্পনা করেছে। সচেতনতার বিশ্ব প্লাস্টিক মুক্ত দিবস হিসেবে ৩ জুলাই দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২৫ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্লাস্টিক বর্জ্য নিধনে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ব্রাজিল, বেলজিয়াম, কেনিয়া, চিলি, পানামা ও ফিলিপাইন। সচেতনতার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কমিউনিটিভিত্তিক সমুদ্রতীর পরিষ্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে কানাডা। ২০০২ সালে সর্বপ্রথম পলিথিনের ক্ষতিকর দিক বিবেচনায় উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, আইনে এটি নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে ১৭টি পণ্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হয়। ঐ বছরে ৮ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন হয় সরকার কর্তৃক।

সাময়িকভাবে বিস্কুট, চানাচুরের মোড়ক হিসেবে পলিথিনের ব্যবহার করা যাবে বলে ঘোষণা করা হয়। আবার উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তার ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার উল্লেখ থাকে। কিন্তু তার বাস্তবতা সুদূর পরাহত। জলবায়ুর পরিবর্তন ও ধরিত্রীর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি।

পলিথিনের পুনর্ব্যবস্থার ও পুনরাবর্তনের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। প্লাস্টিকের সঙ্গে অতিরিক্ত শ্বেতসার, সেলুলোজ মিশিয়ে দিতে পারে হবে। এছাড়াও পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং কাচের তৈরি পণ্যের ব্যবহারও বাড়াতে হবে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে। গ্রাফিন ও জৈব-প্লাস্টিক পরিবেশের ক্ষতি করে না। তাই এটি ব্যবহার করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহম্মেদের খানের পাট থেকে তৈরি পচনশীল, পরিবেশবান্ধব সাশ্রয়ী পলিমার ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবি। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিবেককে কাজে লাগাতে হবে। সব ধরনের প্রচারমাধ্যম, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারসহ মানুষকে সচেতন পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি উপযুক্ত আইন, নীতিমালা ও তার কার্যকরী বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে। সর্বোপরি ব্যক্তির হীন স্বার্থ ত্যাগ করে দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে পরিবেশকে বাঁচাতে উদ্যোগী হতে হবে সবাইকে।

 

মোশারফ হোসেন : প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ

কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

[email protected]

 
Electronic Paper