ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সান্ধ্যকোর্স পদ্ধতি ও উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ

আশেক মাহমুদ
🕐 ৯:৩৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্স বহাল রাখার ব্যাপারে একটি শ্রেণি ব্যাপক তৎপর। সূত্রমতে, খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্যকোর্স আছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদন ছাড়াই চলছে সান্ধ্যকোর্স কার্যক্রম। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় মনে হলেও এর পরিণতি নিয়ে খুব কমই চিন্তা করা হয়। এর ফলে অনেক কম মেধাবীরাই টাকার জোরে পাবলিক ট্যাগ নিয়ে লেখাপড়া করতে পারছে, চাকরির বাজারে হয়ত দামও তারা পাবে, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান যে ক্রমাগত নিম্নগামী এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এ চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ব্যবসাভিত্তিক এসব চর্চা বন্ধ করতে ইঙ্গিত দেন, এমনকি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকোর্স বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অনেকেই জাতীয় স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখতে চায় বিধায় সান্ধ্যকোর্স পদ্ধতি বাতিল করা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্ব হল জাতিকে পথ দেখানো, জাতির সংকট সমাধানে নিজেদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সততা দিয়ে এগিয়ে আসা। এর মানে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সর্বজনীন চিন্তা চেতনা ধারণ করে সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করাই হল শিক্ষকদের কাজ। আর সর্বজনীন শিক্ষা কখনো ব্যবসার ছকে বেঁধে থাকে না। কারো কারো মতে শিক্ষা হল আয় উপার্জনের সিঁড়ি, বেকার সমস্যা লাঘবের উপায় আর রাতারাতি ধনী হওয়ার অভিনব পন্থা। যারা এ ধারণা পোষণ করেন তাদের মধ্যে ‘মানুষ’ নামক ধারণার একটা প্রকট অভাব রয়েছে। সান্ধ্যকোর্সের মাধ্যমে যে স্কিল রপ্ত করার কথা বলা হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, এর জন্য দরকার ট্রেনিং।

ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে- সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি পেতে একাডেমিক সাবজেক্টকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অল্প কিছু পদের জন্য বিবেচ্য রাখা হয়। দর্শন, ইতিহাস, বাংলা পড়েও তারা ব্যাংকে চাকরি করছে। কিন্তু তারা কীভাবে করছে? এটা কি সম্ভব? আর এসব সম্ভব করতেই প্রতিটি ব্যাংকের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

ঠিক তেমনি, সান্ধ্যকোর্স আসলে এক ধরনের ট্রেনিং। এ ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য হল মেধা আর অর্থের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাজারের চাহিদা উপযোগী চাকরি পাওয়ার একটা যোগ্যতা সৃষ্টি করা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো আর ট্রেনিং সেন্টার নয়, সে এ কাজ করে দিতে বাধ্য। বুয়েট তো ইচ্ছা করলে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কাজগুলো সান্ধ্যকোর্স নামে করে দিতে পারে, তাহলে আলাদা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কোনো দরকার পড়ে না। কিন্তু বুয়েটের কাজ তো তা নয়। বুয়েটের কাজ মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা, যাতে নিত্যনতুন কলাকৌশল আবিষ্কারে এটি এগিয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তো পলিটেকনিকের মতো ট্রেনিং সেন্টার নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হল জ্ঞান তৈরির আস্তানা; এখানে গবেষণা হবে, গবেষণাকে বোধগম্য করার জন্য ক্লাস হবে, ডিবেট হবে, আর উদ্ভাবিত জ্ঞানকে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজে লাগানো হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা একাডেমিক গবেষণাকে ভ্রূক্ষেপ না করে শুধু বিসিএসের বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান আর গণিতের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। সবাই একই জিনিস মুখস্থ করছে চাকরির আশায়। এর পেছনে রয়েছে মোটিভেশান ক্রাইসিস। কেননা গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎসাহিত করা হয় না, গবেষণার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উপযোগিতা সৃষ্টি করা হয় না।

অন্যদিকে এক শ্রেণির শিক্ষক (মানে সবাই না) বিশ্ববিদ্যালয়কে অধিক উপার্জনের হাতিয়ার মনে করে, আর সেই সুযোগে সান্ধ্যকোর্সের মাধ্যমে অধিক উপার্জন কুক্ষিগত করতে চায়। এর মানে নিয়মিত ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষতি হলেও আয়ের যেন কমতি না হয়। এক শ্রেণির আমলা ঘুষ দুর্নীতি করে অধিক অর্থ কামায়, অন্যদিকে এরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন ব্যবহার করে ও অন্যায় প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে (ম্যানিপুলেশন কায়দায়) অধিক উপার্জনের পথ তৈরি করে। এটি কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। এর মূল কারণ আধুনিকতার নামে বিদ্যমান প্লাস্টিক চাহিদা, যা রঙিন ভোগবাদের বহিরঙ্গ। আসলে মহৎ কাজগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ে তখনি যখন সার্বিক কল্যাণ চিন্তার চেয়ে বড় হয়ে যায় নিজের প্লাস্টিক চাহিদা। প্লাস্টিক চাহিদার সঙ্গে আত্মকেন্দ্রিকতার বন্ধন অনেক শক্ত, কিন্তু জনগণ উপেক্ষিত থেকে যায়। প্লাস্টিক চাহিদার কাছে সমস্ত মহৎ কর্ম, সততা, নৈতিকতা ও জনকল্যাণ অসাড় ও অর্থহীন মনে হয়। জনঅধিকার ভূলুণ্ঠিত হলেও এখানে ‘আমি’ই প্রধান, এ ‘আমি’গুলো এক হয়ে নির্মাণ করে গোষ্ঠীবাদ। এ গোষ্ঠীবাদীরা হল ‘Vested interest group’ যাদের প্রভাবে জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান আর সৎ শিক্ষকদের ত্যাগ ও মহিমা চাপা পড়ে যায়।

হ্যাঁ, কেউ কেউ এ যুক্তি দিতে পারেন, সময়ের চাহিদা আর বেকার সমস্যা লাঘবে সান্ধ্যকোর্স চালু রাখা অনেকটা জনগণের কল্যাণেরই অংশ। কিন্তু যে সব ছাত্র-ছাত্রীরা পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে নিজ যোগ্যতায় জায়গা করে নিয়েছে তাদের অধিকার, তাদের সুষম শিক্ষা লাভের অধিকার ক্ষুণ্ন করে এ কাজ কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাছাড়া সব কোর্সে সান্ধ্যকোর্স হয় না, তাই অনেক বিভাগের শিক্ষকরা তা মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। টাকা উপার্জন যদি কেন্দ্রীয় বিষয় হয় তাহলে ন্যায়বিচার আর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এ চিন্তা থেকে আমাদের উচিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সান্ধ্যকোর্স থেকে বিচ্ছিন্ন করা।

‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। সান্ধ্যকোর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে যায় না। কেউ কেউ কথায় কথায় বলে, বিদেশে নাকি এগুলোর চর্চা আছে। কোনো কিছু বিদেশে হলেই যে তা গ্রহণ করতে হবে তার কোনো মানে হয় না। দেখতে হবে এর যৌক্তিকতা কোথায়। ইউরোপ-আমেরিকায় চলমান ব্যাংকিং শিক্ষাপদ্ধতির সমালোচনা করে পাওলো ফ্রেইরে তো বলেই গেছেন, এ শিক্ষায় মানুষকে সৃষ্টিশীল করা হয় না, এতে সমাজকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জিত হয় না, এর ফলে অন্যায় কাঠামো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। আমরা কি আমাদের শিক্ষাকে মানবিকতার স্থানে আনতে পেরেছি? নাকি অর্থ আর বিলাসের মানদণ্ডে বিচার করছি। তাহলে আমাদের উচিত হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে সান্ধ্যকোর্সসহ ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করতে হবে।

তবে সান্ধ্যকোর্সের ব্যাপারে ভিন্ন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। ১. সান্ধ্যকোর্স পদ্ধতি বাতিল করে ‘সান্ধ্যকোর্স ইনস্টিটিউট’ করা হোক, এটি সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগে করা সম্ভব; ২. অথবা কেন্দ্রীয় সান্ধ্যকোর্স বিশ্ববিদ্যালয় করা যেতে পারে; ৩. সান্ধ্যকোর্স ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্ন কাঠামোতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত, এখানে আলাদা বেতন কাঠামো থাকবে; ৪. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করা হোক। যাতে করে শিক্ষকদের পার্টটাইম অন্য কোথাও ক্লাস নিতে না হয়। আমরা চাই আমূল সংস্কার ও পরিবর্তন।

আশেক মাহমুদ : সহকারী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]

 
Electronic Paper