ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বন্ধু তুমি, বঙ্গবন্ধু

অয়েজুল হক
🕐 ৯:৩১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ১৭ মার্চ হবে বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। অবাক করার মতো ব্যাপার হল, মার্চ বঙ্গবন্ধুর ধরণীতে আসার মাস। এ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জ্বালাময়ী ঐতিহাসিক ভাষণের মাস। যে ভাষণে ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির ঘোষণা, প্রেরণা। গোটা জাতির ঘুম ভেঙে যায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে। মার্চ স্বাধীনতার মাস। বঙ্গবন্ধু যেন জন্মেছিলেন একটি জাতির আজাদী ও মুক্তির অলিখিত পয়গাম নিয়ে।

দরিদ্র আর অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা জন্মলগ্ন থেকে। সতের বছর বয়স। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সেবা সমিতিতে কাজ শুরু করেন। প্রতি রোববার কিছু কিশোর থলি নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তেন। চাল তোলা ছিল তাদের কাজ। চাল বিক্রির টাকায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বই এবং পরীক্ষার খরচ দেওয়া হতো। গোপালগঞ্জ থেকে যে যাত্রা শুরু তার শেষ হয়নি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের জন্য তিনি ১৯৩৮ সালে প্রথম কারাগারে যান। 

১৯৪০-এর পর থেকে দেশভাগের আগে যখন ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা চলছে তখনও বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হিন্দু মুসলিম দেখেননি অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মজীবনীতে সেটি বর্ণনা করেছেন, সমগ্র কলকাতায় তখন মারামারি চলছে। মুসলমানরা মোটেই সে দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে দাঙ্গার সময় তিনি ও তার সহকর্মীরা মিলে কিছু হিন্দু পরিবারকেও রক্ষা করেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে গুজব ও স্পষ্ট ধারণা দেওয়া প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন- “আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লার সামনে প্রোপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোন কথা নাই, ‘পাকিস্তান’ আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে।” ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। তিনি ছিলেন অসহায় মানুষ ও মানবতার পক্ষে।

৪৭-এ দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশের) মানুষ যখন পদে পদে নির্যাতন, নিপীড়নের স্বীকার হয়ে অসহায়। তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো যখন একের পর এক কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল তখন মুক্তির কাণ্ডারী হতে আবির্ভূত হলেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তাকে বারবার জেলবন্দি করে। এসব করে যে বঙ্গবন্ধুকে থামানো যাবে না সেটা ছিল তাদের ভাবনার বাইরে। ১৯৫২ সালের প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দি থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান রাতে গোপনে ভাষা আন্দোলন নিয়ে মিটিং করতেন। এমন এক মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের এ সব গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড টের পেয়ে তাকে আবার হাসপাতাল থেকে কারাগারে ফেরত পাঠায়। তাতে কী, বঙ্গবন্ধু ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি যেমন শারীরিক অসুস্থতা দেখেননি তেমনি কারাগারের বদ্ধ প্রকোষ্ঠ, নির্যাতন তাকে টলাতে পারেনি। কারাগার থেকে ১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছে মুক্তির জন্য চিঠি পাঠান।

কেন মুক্তি চান! নিজের জন্য? না, মুক্তি চেয়েছেন, ভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য। ওরা আমার মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নেবে। এ চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া যাবে না। তিনি চিঠিতে জানান তাকে মুক্তি দেওয়া না হলে তিনি ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশনে যাবেন। জেল কর্তৃপক্ষ তাকে অনশন না করার অনুরোধ করলে তিনি উত্তর দেন- ছাব্বিশ/ সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করিনি। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় যাব না হয় মৃত অবস্থায় যাব।

মাটি ও মানুষের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা, মমত্ব থাকলে এমন কথা বলা যায়! বঙ্গবন্ধু যে, এ জন্যই তিনি বলতে পেরেছিলেন, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় যাব না হয় মৃত অবস্থায় যাব।

নাতিদীর্ঘ জীবনে বঙ্গবন্ধু কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ১৪ বছর। তার অপরাধ ছিল বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করা। নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত বাংলার মানুষের পক্ষে এমন জোরালো কণ্ঠস্বরকে যে কোনোভাবেই দমিয়ে রাখা যাবে না সেটা পশ্চিমারা উপলব্ধি করতে পারেনি। গরিব, দুঃখী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকল শ্রেণির মানুষের ভালোবাসার একটি নাম বঙ্গবন্ধু। একটি উপাধি।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের ভাষণ থেকেই লাল সবুজের সোনার বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। সাত কোটি মানুষের চোখে যেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন এঁকে দিলেন। রেসকোর্সে এমন ভাষণ আর কে দিয়েছে! একটা ছোট জিপে চড়ে বঙ্গবন্ধু এলেন। রেসকোর্স ময়দানে তিল ধারণের জায়গা নেই। জায়গা না পেয়ে গাছের ওপর, ডালে ডালে মানুষ। বঙ্গবন্ধু এলেন। বললেন- ‘কী পেলাম আমরা? যা আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে গুলি করা হচ্ছে।’

এ ভাষণ এক ইতিহাস। লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে হৃদয়ছোঁয়া বক্তব্য- ‘তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান, ঢাকায় আসেন, কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন।’

কার সঙ্গে আলোচনা, কীসের আলোচনা। পদ, লোভ-লালসা তাকে ছুঁয়ে যায়নি। বঙ্গবন্ধু- মানুষের প্রতি যার রক্তের এক অদৃশ্য বন্ধন তিনিই তো বলতে পারেন, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। বাংলার মানুষের মুক্তি চাই।

মুক্তির সংগ্রামে যারা দিল প্রাণ তাদের বঙ্গবন্ধু আপন করে নিলেন। এমন আপন! বারবার বলেছেন, আমার বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। তাদের প্রতি প্রাণভরা দরদ নিয়ে বললেন, ‘আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, যে ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না।’

স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা কিন্তু ৭১-এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু দিয়ে দিলেন। স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘ভাইয়েরা আমার তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

মুহুর্মুহু স্লোগানে কম্পিত হয় গোটা ময়দান, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আর বাঙালিকে থামিয়ে রাখা যায়নি। ওই যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বাংলার মানুষ লাখো প্রাণের বিনিময়ে নেতার দেখানো স্বপ্ন পথে এগিয়ে গেল। চূড়ান্ত বিজয় হলো হায়েনার বিরুদ্ধে। একটি দেশ- লাল সবুজের। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পরেও পাক হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়নি। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক চাপে তারা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পা রাখেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানের গণসংবর্ধনায় যোগ দেন। সেখানে মানুষের উল্লাস, উচ্ছ্বসিত মুখের হাসি, খুশির ভাষা যেন বলেছিল- বন্ধু তুমি, বঙ্গবন্ধু।

অয়েজুল হক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper