ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নয় মাসের মহাকাব্য

কামরুজ্জামান
🕐 ১২:২৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০

হাজার বছর ধরে কোনো শ্রেণি, সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী যে বিশ্বাস, রীতিনীতি, আদর্শ ও ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জীবন পরিচালিত হয় তাকে সংস্কৃতি বলে। সংস্কৃতি হচ্ছে আয়নাসদৃশ। আয়নাতে যেমন কোনো ব্যক্তি দৃষ্টিপাত করলে তাকে স্পষ্ট দেখতে পায়, তেমনি সংস্কৃতির মাধ্যমে কোনো শ্রেণি, সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। ওই সম্প্রদায় বা দলের আচার-আচরণ, জীবনপ্রণালি, রীতিনীতি কী তা শুধু সংস্কৃতির মাধ্যমেই ফুটে ওঠে। সুতরাং সংস্কৃতি জাতিসত্তার স্পষ্ট পরিচায়ক। তাই সংস্কৃতি একটি জাতির প্রাণ। সংস্কৃতি এবং জাতি- দুটি বিষয়ই এক ও অভিন্ন।

যখন একটি জাতির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হয়, নাশ করা হয় তবে ওই জাতি দিশেহারা, মৃতপ্রায়। সুতরাং একটা জাতিকে ও জাতিসত্তাকে ধ্বংস করতে চাইলে শুধু ওই জাতির সংস্কৃতিকে বিনাশ করলেই যথেষ্ট হবে। এমনটাই বুঝতে পেরে, তৎকালীন শোষক-গোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালির সংস্কৃতিতে আঘাত হানে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন কূটকৌশলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ওপর জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন চালাতে থাকে। একমাত্র ধর্ম ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো কিছুর মিল ছিল না। তাই তারা শাসনের নামে শোষণ শুরু করে।

ব্যবসা, ব্যাংক, বিমা, সামরিক, রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে পশ্চিমারা হিংসার অনল জ্বালাতে থাকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা পহেলা আঘাত হানে ভাষার ওপর। ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। আন্দোলনের মুখে পড়ে পশ্চিমারা বাংলা ভাষার বিন্দুমাত্র ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। কিন্তু তাদের অপচেষ্টা সাঙ্গ হয়নি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে সামরিক শাসন জারি করে। সামরিক শাসন জারি করেই বাঙালির সংস্কৃতির ওপর দ্বিতীয়বারের মতো থাবা দেয়। রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রয়াস করা হয়। বাংলা ভাষা সংস্কারের অপচেষ্টা করা হয়। ১৯৫৯ সালে ‘ভাষা সংস্কার’ কমিটি গঠন করা হয়। এর প্রতিবাদে সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করে ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রতিবাদলিপি ছাপানো হয়। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা সংস্কারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করেন।

যার হাত ধরে বাংলা ভাষা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে, তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পশ্চিমারা রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে। এর নিন্দা জানিয়ে ১৯৬৭ সালের ২৫ জুন পূর্ববাংলার ১৮ জন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। তবে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ২৮ জুন সংখ্যায় বিবৃতিদাতার সংখ্যা ১৯ জন বলে উল্লেখ করে। বিবৃতিটি এমন- ...সরকারি মাধ্যম হইতে রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হইয়াছে। এ সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও ভিন্নতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতি নির্ধারণের সময় এ সত্যের গুরুত্বকে মর্যাদা দান করা অপরিহার্য’। এ বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি প্রদান করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পাকিস্তানপন্থী পাঁচজন শিক্ষক- অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, এ কে এম মুনিম, এম শাহাবুদ্দিন, ড. মোহর আলী, এ এফ ম আব্দুর রহমান। বিবৃতিটি ২৯ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি ছিল এমন- ‘১৮ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতির ভাষায় এই ধারণা জন্মে যে, স্বাক্ষরকারীরা বাংলাভাষী পাকিস্তানি ও বাংলাভাষী সংস্কৃতির মধ্যে সত্যিকারের কোনো পার্থক্য রয়েছে বলে স্বীকার করে না। বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এ ধারণার সঙ্গে আমরা একমত নই বলে এই বিবৃতি দিচ্ছি’। পরে পাকিস্তানপন্থী সাহিত্যিক সাংবাদিকরা রবীন্দ্রনাথের বিকল্পস্বরূপ কাজী নজরুল ইসলামকে দাঁড় করানোর প্রয়াস নেন। সরকারি মদদে ‘নজরুল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করে। যদিও তারা এটাও মনে করত, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার শব্দগুলো ইসলামসিদ্ধ নয়। পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের আরেকটি কলঙ্কজনক প্রচেষ্টা ছিল বাংলা সাহিত্যের ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দগুলোর পরিবর্তে আরবি ও ফারসি শব্দের ব্যবহার। যেমন কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা ‘চল চল চল’ এর একটি চরণ ছিল- ‘নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিব মহাশ্মশান।’

এটি সংশোধন করা হয় এভাবে- ‘নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিব গোরস্থান।’

আরেকটি প্রচলিত কবিতা- ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ এটার সংশোধিত রূপ দেওয়া হয়েছে- ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি/ সারাদিন আমি যেন নেক হয়ে চলি।’

এমন করেই পশ্চিমারা বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য বাঙালি বোধ, চেতনা, জাতিসত্তাকে বিনাশ করা অপচেষ্টা চালিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্র সংগীতকে নিষিদ্ধ করা, কাজী নজরুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামিকরণ করা পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা, বাঙালিকে ধ্বংস করা, শোষণ করা, রক্তখেকোর মতো বাঙালির রক্ত চুষে খাওয়া। যে পশ্চিমারা ইসলামের নাম করে বেড়াত তাদের মধ্যে ইসলামের কোনো চিহ্ন ছিল না। যদি থাকত তবে নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করত না। যুদ্ধকালে ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম নিয়ে শকুনের মতো টানা-হেঁচড়া করত না। পশ্চিমারা ইসলামকে পুঁজি করে ধর্ম ব্যবসায় লিপ্ত হয়।

পশ্চিমারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে বাঙালির রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তাদের এ আগ্রাসন বাঙালির মনে ঘৃণার আগুন তীব্র করে স্বাধীনতার বীজ বুনে দেয়। যার ফলে বাঙালি ঐক্যতানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে ধাবিত হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ফিরে পায়, তার সেই হাজার বছরের স্বপ্নের ঠিকানা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’।

কামরুজ্জামান : কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]

 
Electronic Paper