ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মানহীন লেখা ও কিছু কথা

মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
🕐 ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০

একটা সময় ছিল, নিজের লেখার প্রশংসা শুনতে ভীষণ ভালো লাগতো। তখন নিজেকে লেখক ভাবতাম। এখন সমালোচনা শুনতে ভালো লাগে। কারণ, এখন নিজেকে স্রেফ পাঠক ভাবি। লেখক আর পাঠক ভাবা-ভাবির কারণও আছে। কারণটা নির্ভর করছে কেমন বই পড়ছি তার ওপর।

একটা সময় ছিল সারাক্ষণ হুমায়ূন আহমেদকে পড়তাম। রাত জেগে হিমু সিরিজ, মিসির আলী সিরিজ ও শুভ্র সিরিজ পড়েছি। তখন হুমায়ূন আহমেদ স্যার ছাড়া তেমন কোনো লেখকের লেখার সঙ্গেও পরিচিত ছিলাম না। স্যারের লেখা নিয়ে কেউ সমালোচনা করলে তাকে আমার কলমের খোঁচায় হত্যা করার বাসনা জাগতো। মনে মনে বিড়বিড় করতাম, বেটা হিংসুক, হুমায়ূন আহমেদ স্যারের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারে না।

এখন আহমদ ছফাকে পড়ছি, শাহেদুজ্জামানকে পড়ছি, কাবিলের বোন, ও উপমহাদেশের রচয়িতা- আল মাহমুদকে পড়ছি, শরৎচন্দ্রকে পড়ছি, রবীন্দ্রনাথকে পড়ছি, কালপুরুষের জনক- সমরেশ মজুমদারকে পড়ছি। পড়ছি আরো অনেক খ্যাতিমান লেখকের লেখা। এখন আর হুমায়ূন পড়ে মজা পাই না। হুমায়ূনের সমালোচকদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিও নিক্ষেপ করি না। তার মানে এই নয় যে, হুমায়ূন আহমেদ স্যারকে আমি ডাস্টবিনে ছুড়ে মারছি। আসলে হুমায়ূন আহমেদ স্যার আমার গুরু। কারণ, স্যারের তৃপ্তিকর লেখার হাত ধরে সাহিত্য জগতে পা না মাড়ালে আমি উপযুক্ত এসব খ্যাতিমান লেখক পর্যন্ত আসতে পারতাম না। এখন নিজেকে যে একজন যোগ্য পাঠক ভাবতে পারছি তাও হুমায়ূন আহমেদ স্যারের অবদান বলে মনে করি। নতুন লেখকদের সমালোচনা করে আজ একজন পোস্ট দিয়েছেন। আমি নিজেই একজন নতুন লেখক হিসেবে তার লেখা পোস্ট গোগ্রাসে গিলেছি বটে, হজমও করেছি। আমার মাথায় দারুণ কাজ করছে তার কথাগুলো। তিনি বলছেন ‘ছাইপাঁশ কি লিখেন মিয়া!’ কেজি মাপা বিক্রি করে বাদাম, চনাবুট খেতে মন চায়। সস্তা টাইপের উপমার একটা লাইন বলে বললেন, ‘এটা একটা উপমা হলো?’

গতকালের একাত্তর টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন দেখলাম, তাতে বলা হয়েছে এ কয়দিনে মেলায় হাজার দেড়েকেরও বেশি নতুন লেখকের বই উঠেছে, তার অধিকাংশ মানহীন। মাত্র কিছু বই টিকে যাবে এবং অধিকাংশ হারিয়ে যাবে। এক বছর না পেরুতেই হারিয়ে যাবে। মানহীন লেখা, ছাইপাঁশ লেখা এসব শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। নতুন লেখক কেন মানহীন লেখা লিখবেন? এর জন্য একজন নতুন লেখক যতো না দায়ী তারচেয়ে ঢের দায়ী প্রকাশক। প্রকাশকের সঙ্গে এখন দায়ী করবো কিছু কিছু সাহিত্য গ্রুপকে। সাহিত্য গ্রুপে কবি লেখকদের সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়ে থাকে। দৈনিক সেরা, মাসিক সেরা কবি লেখকের সার্টিফিকেট। আচ্ছা, আপনি যে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, আপনি কতোটুকু সাহিত্য বোঝেন? উপমা, উৎক্ষেপণ, ছন্দ, তাল এসব নিয়ে আপনার কতোটুকু পড়াশোনা আছে? নিজে কতোটুকু বোঝেন? যদি নাই বুঝে থাকেন তাহলে অন্য জনকে সাহিত্যের সেরা সার্টিফিকেট দিয়ে তার কঁচি মনকে উতলা করছেন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে? আপনার সার্টিফিকেট পেয়ে আত্মহারা হয়ে যাই আমরা। নিজেকে লেখক ভাবতে শুরু করি। তারপর ছাইপাঁশ লিখি।

দ্বিতীয়ত: প্রকাশককে দায়ী করবো। অনেক প্রকাশনী এখন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। রমরমা ব্যবসা চলছে। তারা লেখা দেখে না, সাহিত্যের রস আছে কি নাই তা দেখে না, মান দেখে না কেবল টাকার অঙ্ক দেখে। দরকষাকষি করে আপনি টাকা বুঝিয়ে দিয়েছেন তো, তিনি আপনাকে মলাটবদ্ধ বই বুঝিয়ে দেবেন। এবার আপনার পালা। বই কোথায় বিক্রি করবেন, টাকায় বিক্রি করবেন নাকি সৌজন্য কপি দিবেন, ফেসবুকে প্রচার করবেন নাকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন সেটা আপনার বিষয়।

প্রকাশনীর জগতে এখন আসছে আরো নতুন চমক। যৌথ কাব্যগ্রন্থ, যৌথ গল্পগ্রন্থ বের করার জন্য পোস্ট দেওয়া হয়ে থাকে। লেখা আহবান করা হয় থাকে। আপনাকে ইনবক্স করবে, লেখা দিন। তবে শর্ত প্রযোজ্য। কি ‘শর্ত’? হুম, টাকার শর্ত। বই কেনার শর্ত। সেখানে আবার পদকও দেওয়া হবে। সাতজন দশজন মিলে যৌথ গ্রন্থ হলে পাঁচজনকে ক্রেস্ট প্রদান হবে। তাও লেখকের টাকায়। কতো সুবিধাজনক ঝুঁকিবহন বিহীন ব্যবসা!

সেদিন একজন ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিনের জন্য লেখা আহবান করছেন। আমি লেখা জমা দিতে চাইলে তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন! শর্ত হলো চড়া দামে বিক্রি করা তিনটি-পাঁচটা ম্যাগাজিন কিনতে হবে। তিনি আবার নিজেকে সম্পাদক পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন।

আপনার ব্যবসা করতে হলে হকারের দোকানে পত্রিকা দিন। হকার দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। কতো কষ্ট করে তারা! ঝড় বৃষ্টি তোয়াক্কা করে না। তাও না পারলে অন্য ব্যবসা করেন। নতুনদের আবেগ অনুভূতিকে পুঁজি করে কেন ব্যবসা করতে যাবেন? ব্যবসা জমানোর জন্য মানহীন বই করে পাঠককে কেন হতাশ করবেন?

প্রকাশকদের উচিত হবে, পাণ্ডুলিপি ভালো করে পড়ে দেখা। লেখার মান ভালো হলে মাথায় ছুঁইয়ে স্যালুট করা এবং মানহীন হলে ছুড়ে মেরে ক্রোধান্বিত চেহারায় বলা, ‘এই মিয়া, কয়টা বই পড়ছো? কতোজন লেখককে পড়ছো? আগে অমুক অমুক লেখকের বই পড়ো। এক বছর পর আসো। আমি নিশ্চিত মানহীন বইয়ের সংখ্যা মেলায় উঠবে না। ছাইপাঁশ লিখা মলাটবদ্ধ হবে না।

আমরা কথায় বলি, মানহীন লেখার জন্য সারাক্ষণ ভয়ে থাকি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো কোনো যোগ্য পাঠক আমার বই নিয়ে সমালোচনা করছে না। কেবল আমার কিছু শুভাকাক্সক্ষী, নতুন পাঠক বাহবার তরঙ্গ সৃষ্টি করে তার ঢেউয়ে আমার কলমের বৈঠা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কি আর করা! আমি নিজেই আমার লেখার সমালোচনা করি এবং মান বজায় রাখার চেষ্টা করি।

মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper