ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাংলা ভাষায় স্বাধীন অস্তিত্ব

তুহীন তৌহিদ
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০

বাংলা ভাষাই আমাদের স্বাধীনতার ভ্রূণ। এ উপলব্ধিটা প্রথম থেকেই আমাদের যারা শাসন ও শোষণ করেছে তাদের মধ্যে ছিল। যার ফলে তারা সবসময় আমাদের ওপর অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার নীলনকশা করত। তারা বাংলাকে মুছে ফেলতে ও বিকৃত করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা ও সংশোধনী প্রণয়ন করে।

দেশ বিভাজনের পূর্বে ভারতের আন্দোলনের সময় গান্ধীজির অনুরোধে ডা. জাকির হোসেনের শিক্ষা পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলেন। এতে ছিল, সর্বভারতীয় ভাষা হবে হিন্দুস্থানি এবং সেগুলো লিখিত হবে দেব নগরী ও উর্দু উভয় হরফে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাবল, পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং ধর্মান্ধতা বাঁচিয়ে না রাখলে পাকিস্তানের একক অবস্থান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারা ভীত ছিল বিভিন্ন কারণে, কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের পূর্ববাংলার জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশের ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো কিছুর মিল ছিল না। না ছিল ভাষায়, না ছিল সংস্কৃতিতে। সুতরাং তাদের সবসময়ের এবং সবচেয়ে প্রধান লক্ষ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলাকে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কীভাবে একটি সাধারণ অবস্থানে আনা যায়। পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সাহেব প্রস্তাব করেন, বাংলা বর্ণলিপি বর্জন করে আরবি হরফ গ্রহণ করা উচিত।

তাতে দুটো সমস্যার সমাধান হবে- ১. পশ্চিম বাংলার ভাষার সঙ্গে পূর্ব বাংলা ভাষার কোনো সম্পর্ক থাকবে না, ফলে পূর্ববঙ্গ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারত বর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। ২. আরবি হরফে লিখিত হওয়ার ফলে ক্রমশ পূর্ববাংলার বাংলা ভাষা উর্দুর কাছাকাছি আসবে এবং এর প্রভাবে একদিন সমগ্র পাকিস্তানে সর্বজনস্বীকৃত একটি সাধারণ ভাষার সৃষ্টি হতে পারে।

ধর্মপরায়ণ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপকবৃন্দ এবং ছাত্রসমাজ প্রকাশ্যে ফজলুর রহমানের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। একটি প্রকাশ্য সভায় ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আমাদের ধর্ম যাই হোক না কেন, প্রকৃতি, ভ‚গোল এবং ইতিহাস আমাদের সর্ব অবয়ব এবং মানসিকতায় বাঙালি যে স্বরূপ রেখেছে তা মুছে যাবার নয়।’

ফজলুর রহমানের প্রচেষ্টার পর কবি গোলাম মোস্তফা একটি তথাকথিত গবেষণার সূত্রপাত করেন। তিনি তার ভেতর দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, ‘আরবি বর্ণমালাই পৃথিবীর সকল বর্ণমালার জননী’। তবে এ হাস্যকর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া কোন আন্দোলনের সূত্রপাত করেনি। পরে বাংলা বর্ণমালার সংশোধনী কমিটি মওলানা আকরাম খা’র নেতৃত্বে গঠিত হয়। এবারও তার চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক সংশোধনীকে কেউ গ্রহণ করেনি। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর গণবিরোধী ঘোষণাকে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং অনেক নাম না জানা বীর শহীদের নেতৃত্বে সবাই প্রত্যাখ্যান করেছে।

২১ ফেব্রুয়ারির ২১ দফা থেকেই শুরু হয় মূলত আমাদের স্বতন্ত্র বাঙালি অস্তিত্বের জন্য আন্দোলন। সে সময় পূর্ববঙ্গে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার উদ্ভব ঘটতে দেখা যায়। শুধু তাই নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংঘটন ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংঘটনগুলো অসাম্প্রদায়িক ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা শুরু করে। ২১ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী সময় ধর্মনির্ভর রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অবস্থা নাজুক হতে শুরু করে।

এ ভাবে আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালি অস্তিত্বের রাজনৈতিক প্রকাশ ঘটতে শুরু করে, যার মূল ভিত্তি ছিল এ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চর্চা ও অসাম্প্রদায়িকভাবে সংঘটিত হওয়া। এর প্রতিফলন ঘটে ৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় এবং পূর্ব বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগ তথা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নির্বাসনের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে যুক্তফ্রন্ট সরকার স্থায়ী না হলেও আন্দোলনের মুখে ৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর পর আমরা অল্প অল্প করে এগিয়ে যাই অনেক দূর। যার ফলাফল সম্পর্কে আমাদের শাসকগোষ্ঠী মোটেই বুঝে উঠতে পারেনি।

২১ ফেব্রুয়ারির ২১ দফা, ৬ দফার মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলন এবং তারপর এর প্রচণ্ডতা প্রকাশ পায় ১১ দফার মাধ্যমে যা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলা ভাষায়ই আমাদের পৃথক অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। বাঙালিত্বের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তির ওপর মহান স্বাধীনতা দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অর্জিত। সুতরাং বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন যথার্থ হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইংরেজি শিক্ষিত হওয়া মোটেই অপরাধের নয়, কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অপসংস্কৃতি ধারণ করে অন্যদের চেয়ে নিজেকে আলাদা ভাবা মোটেই যুক্তি সংগত নয়।

কিন্তু আজ মন্দ হলেও বলার অপেক্ষা রাখে না- গজিয়ে ওঠা নব্য ধনিক শ্রেণি, দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা, সরকারি প্রথম শ্রেণির অসৎ আমলারা, কিছু তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে, পৃষ্ঠপোষকতা করছে কিন্ডারগার্টেন, তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশে ফিরিয়ে এনে নতুন এক শ্রেণির সৃষ্টি করেছে। যারা বাংলা ভাষায় এবং বাংলাদেশে শিক্ষিতদের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করছে। বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে। দেশকে ভরে তুলছে অপসংস্কৃতিতে আর বিকৃত করছে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।

বাংলার সর্বজনীন ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে পুরো বাঙালি জাতিকে সংঘটিত হতে হবে। তবেই আমরা রুখতে পারব অপসংস্কৃতিকে। যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে বাংলা ভাষাকে। এর মাধ্যমেই আমরা একটা সুন্দর, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ আশা করতে পারি।

তুহীন তৌহিদ : কলাম লেখক

 
Electronic Paper