ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মাদকের চিকিৎসা না অন্তরালে মাদক ব্যবসা

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
🕐 ৯:২৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০

দেশে মাদকের ব্যবহার ও এর নেশাগ্রস্ত লোকজনের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে তাতে গোটা জাতি উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। মাদক এখন সামাজিক ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। কেন না মাদক সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাদকের আগ্রাসনের শিকার হয়ে দেশের যুবসমাজ নৈতিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে সমাজের ওপর দেশের-শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি-অগগ্রতি ও ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, তাদের উল্লে­খযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্ততে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে সেদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ স্পিরিট ইত্যাদির নেশায় মেতে উঠেছে।

গরিব রিকশা-অটোরিকশাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, কুলি, দিনমজুর, পথ শিশুকিশোর ইত্যকার শ্রেণির এক বিরাট অংশও নানারকম নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। সত্য কথা বলতে কি, মাদকাসক্ত বর্তমান সময়ে সমাজের এক সর্বনাশা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আরও ভয়ের কারণ, সমাজে মূল্যবোধের নানারকম পতন-স্খলনের ছত্র-ছায়ায় দ্রত বাড়ছে এই সর্বনাশা পাপ।

মাদকাসক্তের ভয়াবহ ধ্বংস হতে রক্ষার জন্য অবশ্যই সামাজিক সচেতনতা জোরদার করা খুবই দরকার। তবে পাশাপাশি প্রয়োজন সমাজে যা তরুণদের জন্য হতাশার কারণ, সেই বেকারত্ব দূর করা। সমাজে মাদকাসক্তের বিস্তার বলতে গেলে এখন উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে; কিন্তু তার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক ঘটনা হচ্ছে মাদকাসক্ত নিরাময়ের উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রের অনৈতিক ও সমাজ বিধ্বংসী বাণিজ্যিক কার্যকলাপ।

খোদ রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী শত শত মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠলেও এগুলোর ক’টির সরকারিভাবে বৈধ অনুমোদন আছে সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। বেশিরভাগ নিরাময় কেন্দ্রের নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার ও নার্স। মূলত অধিকাংশ নিরাময় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে মাদকদ্রব্য বেচাকেনার আখড়াগুলোর সন্নিকটে। এসব কেন্দ্রের অধিকাংশের মধ্যেই সার্বক্ষণিক কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা মেডিসিনের ডাক্তার নেই।

মাদকাসক্তদের চিকিৎসার পরিষ্কার বিছানাপত্র, লকার, স্যালাইন স্ট্যান্ড, স্ট্রেচার বেডপ্যান, ইউরিনাল, ফ্লেমিটার ও মাস্কসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার, ট্রান্সফিউসন সেট, ইলেকট্রিক শকার, সার্জিক্যাল কাঁচি, রেফ্রিজারেটরসহ বিভিন্ন মালামাল ও যন্ত্রপাতি এবং জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের জেনারেটর থাকা বাধ্যতামূলক হলেও এসবের বেশিরভাগই নেই। নেই অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণও। অথচ এসব কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যয়ভার অত্যধিক এমনও অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্র রোগীর আর্থিক সচ্ছলতা কিংবা পারিবারিক সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে রীতিমতো ব্ল­াকমেইলিং করে থাকে। মাদকাসক্ত রোগীদের দীর্ঘদিন চিকিৎসার নামে ক্লিনিকে রেখে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার হতে এসব কেন্দ্রে চিকিৎসা করতে এসে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে। কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীরাই জড়িত এবং প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে তারা মাদকের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেও ব্যবহার করে এমন অভিযোগও আছে। নিরাময় কেন্দ্রে দীর্ঘদিন রোগী ধরে রাখার জন্য স্বল্প পরিমাণ মাদক প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা পদ্ধতি চালানো হয়ে থাকে। এটিকে সম্পূর্ণ অনৈতিক পদ্ধতি আখ্যায়িত করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ পদ্ধতিতে রোগীকে কখনও সুস্থ করা সম্ভব নয়।

মাদক গ্রহণ ও এর বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকা একটি সামাজিক ও নৈতিক অপরাধ। এই অপরাধের বিস্তার রোধে দেশের প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্ব ও ভূমিকা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ও এনজিওগুলোকে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি কার্যকর বিধায় এ ব্যাপারে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও মাদকবিরোধী অভিযানকে যেন তাদের কর্মসূচির অংশ করে নেয়। দেশব্যাপী যে হারে মাদকসেবার সংখ্যা বাড়ছে তাতে থানাভিত্তিক মাদক প্রতিরোধ কমিটি স্থানীয় কমিশনার, চেয়ারম্যান বা সমাজসেবকদের নিয়ে সরকারিভাবে গঠন করা যেতে পারে।
মাদকের ভয়াবহতা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, ভাষা, শ্রেণি, পেশা, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাইকে আক্রমণ করতে উদ্যত। এটি একটি সামাজিক অভিশাপ। বিশেষত তরুণ-তরুণীরা মাদকের ভয়াবহতার প্রধান শিকার। তাই শুধু বর্তমানই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে ও মাদক বিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণ সবার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার রোগ নিরাময়ের চাইতে রোগ প্রতিরোধক উত্তম পন্থা। একইভাবে মাদকাসক্ত নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রগুলো সঠিকভাবে চলছে কি-না, সে ব্যাপারে কেন্দ্রগুলো সঠিকভাবে চলছে কি-না সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি জোরদার করতে হবে।

মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী : গণমাধ্যমকর্মী

 

 
Electronic Paper