ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পাঠকের মতামত

ড. শামসুজ্জোহা : বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী

গোলাম মোস্তফা
🕐 ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০

বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক, গবেষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রক্টর। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতির এ মহান ব্যক্তিত্বকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

ড. শামসুজ্জোহা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতার। তাই তো তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধারণ করতে শেখাতেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অভিভাবকসুলভ আচরণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মাঝেই তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ড. জোহার নামটি স্মরণ করতে হয় স্বাধীনতার আন্দোলনের শুরুর প্রেক্ষাপট থেকে। দেশবিভাগের পর থেকেই পাকিস্তান সরকার এদেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক সবার কণ্ঠকেই চাপা দিতে চেষ্টা করে।

এ দেশের মানুষের সম্পদ পাচার করে নির্যাতন শুরু করে। ফলে ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ জানাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতা অর্জনের দিকে। পাকিস্তান সরকার এসব বুঝতে পেরে ষাটের দশককে উন্নয়ন দশক হিসেবে ঘোষণা করে এবং ১৯৬৮ সালে এসে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে।

এ দেশের ছাত্রসমাজ ও সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গণ-আন্দোলনে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হন। আর ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ হন সার্জেন্ট জহুরুল হক। এসবের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চরম আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন এবং তারা পরে বিশাল মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান ফটকের দিকে এগোতে থাকেন। ড. শামসুজ্জোহা এ সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীরা ড. জোহার নির্দেশেই শৃঙ্খলভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সেই আন্দোলন ছিল পাকিস্তান সরকারের অন্যায় শাসন শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন। মূলত এ বিশাল আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ড. শামসুজ্জোহার বলিষ্ঠ নির্দেশনা ও ভূমিকা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেটা ভালোভাবেই খেয়াল করেছিল।

ড. শামজ্জোহা ছিলেন সামনের সারিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা শিক্ষার্থীদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেছিল। ড. জোহা সেনাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘এ দেশের আর কোনো শিক্ষার্থীর বুকে যেন একটাও গুলি না লাগে। কোনো গুলি যদি লাগে, সেটা যেন আমার বুকে ছোঁড়া হয়’। শিক্ষার্থীরা যেন আন্দোলনে তুমুল শক্তি ফিরে পেল। নিষ্ঠুর পাকিস্তানি সেনারা তাই আর দেরি করল না। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ড. জোহাকে তারা গুলি করল। শহীদ হলেন আন্দোলনের প্রাণশক্তি শিক্ষার্থীর প্রিয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা।

এই যে ড. শামসুজ্জোহা আন্দোলনের প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, এটা কোনো একদিনের ইতিহাস নয়। কেন না ড. জোহা ছিলেন অসম্ভব মেধাবী একজন গবেষক, শিক্ষক এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে খেলাধুলার নানা প্রতিযোগিতা ও আয়োজনে তিনি নেতৃত্ব দিতেন। শিক্ষার্থীদের সুষম বিকাশে ক্রীড়াপ্রেমী ড. জোহা খেলাধুলাকে শিক্ষার্থীদের মাঝে জনপ্রিয় করেছিলেন।

বিজ্ঞানের জটিল জটিল সব গবেষণায় তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। এ দেশের রসায়ন শাস্ত্রের উন্নয়নে তার অবদান অসামান্য। মূলত প্রকৃত শিক্ষকের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী যেসব গুন প্রত্যাশা করে, তার সবই ছিল ড. জোহার ব্যক্তিত্বে। ১৯৬৯ সেই গণআন্দোলনের সময় ড. জোহা ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। শিক্ষার্থীরা যেকোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে যেতে পারত। সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি শিক্ষাথীদের আপন অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, সেই স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ছিলেন ড. শামসুজ্জোহা। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে ড. জোহাকে নিয়ে চর্চা হয়েছে খুবই কম। শিক্ষিত মহলেও ড. জোহাকে নিয়ে কোনো চর্চা চোখে পড়ার মতো নয়। এমনকি ড. জোহার মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি করে এলেও সেটির বাস্তবায়ন নেই।

ড. জোহার কর্ম ও জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি ছিলেন মানবিকবোধ ও গুণাবলিসম্পন্ন শিক্ষক। তিনি রসায়নশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছিলেন। স্ট্রিট ওয়েস্ট লন্ডন কমার্স কলেজে শিক্ষকতাও করেছিলেন। কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করেনি। তাই তো তিনি দেশে এসে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছেন। মূলত তিনি এ দেশের মুক্তির আশায় স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই বুলেটের আঘাতে পাকিস্তান সরকার তার শক্তিকে নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল পাকিস্তান সরকারের চরম ভুল।

কেন না ড. জোহার আত্মত্যাগ এদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আজ যখন চারিদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিবাদ, অশিক্ষকসুলভ আচরণ ও শিক্ষক শিক্ষার্থীদের খারাপ সম্পর্কের খবর শুনি, আমরা তখন ফিরে আসি ড. জোহার জীবনালেখ্যে। তার আত্মত্যাগের ইতিহাস এ দেশকে সমৃদ্ধ করেছে।

আমরা চাই ড. জোহার আদর্শ ধারণ করে এগিয়ে যাক এদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাজ। আর একটি কথা, মহান এ শিক্ষকের স্মরণে ১৮ ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু দিবসে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে পালিত হোক জাতীয় শিক্ষক দিবস।

গোলাম মোস্তফা : এমএসএস, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper