ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভাষাপ্রেম ও ভাষার অমর্যাদা

অমিত গোস্বামী
🕐 ৯:৪৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০

নৃতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে প্রথম জেনেছিলাম, প্রস্তর যুগে যখন শিকার ও আহরণের সাহায্যে মানুষ জীবনধারণ করতো তখন তারা সৃষ্টি করেছিল ভাষা। উদ্দেশ্য পারস্পরিক ভাবপ্রকাশ। ক্রমে স্থান ও কালের নিরিখে তার আঙ্গিক হল বহুবিধ। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলে অনেক ভাষার সৃষ্টি হল। কিন্তু সেই ভাষার উপস্থিতি চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হল যাকে বলা হয় লিপির প্রচলন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এরও বহু পরে খ্রিস্টপূর্ব দুইশ’ পঞ্চাশ অব্দের প্রায় কাছাকাছি সময়ে সম্রাট অশোকের লিপি সৃষ্টি হয়েছিল।

তারও পর কুণাল লিপি, গুপ্ত আমলে গুপ্ত লিপি, মৌর্য লিপি, আর্যলিপি, কুটিল লিপি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছিল। এক হাজার খ্রিস্টাব্দের সময় নাগাদ প্রাচীন বাংলা লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্টি হল বাংলা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা। বিশ্বে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলেন। যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই হল আফ্রিকার ব্যবহৃত ভাষা। এদের অনেকেরই বর্ণমালা নেই।

তবে পৃথিবীতে একশ’ কোটিরও বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সেটি হল চীনা ভাষা। চীনা শব্দে প্রায় সত্তর হাজার চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। পনেরশ’ শতকে আধুনিক ইংরেজির সূচনা হয়। ১৬০৪ সালে প্রথম ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে এখানকার আধুনিক ইংরেজি শব্দের প্রচুর ফারাক আছে। স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন পৃথিবীর তেত্রিশ কোটিরও বেশি মানুষ।

চিলি, মেক্সিকো, পানামা, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, গুয়েতমালা, গিনি, কিউবা, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে, ভেনেজুয়েলা, এল সালভাদর ইত্যাদি দেশের রাষ্ট্রভাষাই হল স্প্যানিশ। এমনকি কানাডা মরক্কো ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রেও স্প্যানিশ ভাষার চর্চা হয়। ব্রাজিল, এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে এবং পর্তুগালে, পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলেন সাড়ে তের কোটিরও কিছু বেশি মানুষ। ফরাসি ভাষায় বিশে^ প্রায় দশ কোটি মানুষ কথা বলেন। ফ্রান্স তো বটেই, সুইজারল্যান্ড, জার্মান, বেলজিয়াম, কানাডা, আফ্রিকা, ইতালি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রায় ফরাসি ভাষা ব্যবহৃত হয়। রোমান ভাষায় কথা বলেন বলকান ও রোমানিয়ার আড়াই কোটি মানুষ। স্পেন নানা দেশে তাদের উপনিবেশ বিস্তার করতে শুরু করার সঙ্গে তাদের ভাষাও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আমেরিকার প্রায় সব জায়গায়ই।

মাতৃভাষাই সমস্ত গোষ্ঠীকে এক জাতিতে একত্রীভূত করে। কবি একদা লিখেছিলেন- মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা...। আমাদের এ বাংলা ভাষায় এমনই এক ঐতিহ্য আছে যা কিনা বৃহৎ এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আগলে রেখেছে নিজস্ব বনেদিয়ানায়। বস্তুত ভাষাকে মাধ্যম করেই এক একটি অঞ্চল বিশেষে এক একটি জনজাতির সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। পৃথিবীর জনসংখ্যার নিরিখে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বিশ্বে বহুল প্রচারিত ভাষাগুলোর মধ্যে সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম। বাংলা ভাষাটি মূলত ইন্দো-আর্য ভাষা।

সংস্কৃত পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। খ্রিস্টাব্দ প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর অপভ্রংশ থেকে যে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভব হয়, তার মধ্যে বাংলা একটি। বাংলা ভাষার ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- ১. চর্যাপদ (৯০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ), ২. মধ্য বাংলা (১৪০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এর মধ্যে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ধরা হয়। ৩. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। তবে ভাষারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষার কথ্য রূপের জেলাভিত্তিক কিছু কিছু প্রভেদ থাকলেও বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বিশেষ করে সাহিত্য, ইতিহাস, সংবাদপত্র, গান ইত্যাদিতে এ ভাষা ব্যবহারকারীকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয়।

সমসাময়িক বিশ্লেষণে এটা দেখা যায়, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালির যে অতীত গৌরব ছিল, তা এখন অনেকখানি ইতিহাসে পরিণত। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ভাবের ঘরে চুরি করার মতোই এই ‘মহান একুশে’ বা ‘উনিশে মে’ পালন করে সত্যিই কি বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগের ব্যবহারিক দিক মসৃণ হচ্ছে। বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সেমিনারে প্রথিতযশা সাহিত্যিককে সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায়- বাংলা ভাষাটাই আদৌ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ আছে কিনা। গত শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের রফিক, বরকত, জব্বারের মাতৃভাষার জন্য আহুতি দানকে এতগুলো বছর পরও স্মরণ করে, আবেগ আতিশয্যে প্রতিবছর ‘ভাষা শহীদ দিবস’ পালন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেই।
এ বিষয়ে কতই না উদার কণ্ঠে, সোচ্চারে বা ব্যানার লিখনে, পত্রিকার ক্রোড়পত্রজুড়ে ওই কিছু সময় চলে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র চর্বিতচর্বণ। হয়ত এ আকুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই বাংলাদেশেও মাতৃভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। চালু হচ্ছে উদ্ভট বাংলা। বাংলা ভাষাটাই যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন তো প্রকৃত বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মিশেল দেখে দেখে, শুনে আমরা এতটাই ধাতস্থ হয়ে গেছি এ জগাখিচুড়ির ব্যাপারে আর কোনও তাপ-উত্তাপ বোধ করি না।

জেন ওয়াইয়ের সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রজন্মও ইন্টারনেটে টুইটার ফেসবুক চ্যাটে মোবাইল বার্তাতেও মিশ্র ভাষায় দিব্যি সড়গড় হয়ে গেছি। অযথা তত্ত্বকথায় ভারী ভাষার মাসের আবেগ আতিশয্যের বাহুল্য অনেকটাই আপেক্ষিক মাত্র। এ বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন চাহিদা সত্ত্বেও ভাষার মিশেল যেন ঐকান্তিক হয়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত একটা রব প্রায়ই ওঠে যে বাংলা বই পড়ার অভ্যাস বা পাঠকের সংখ্যাও দিনকে দিন কমে আসছে। এ সর্বনেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নততর করলেও মানুষের বাংলা পাঠের অভ্যাসকে গ্রাস করছে।

এমন একটা কথাও প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে বাঙালিই নাকি বাংলা ভাষাটাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার মূল্য, কথন ও পঠনপাঠনেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীংকালে বিশেষ করে বাংলা বইয়ের পাঠক সংখ্যা কিন্তু বাড়েনি। যদিও কলকাতা বইমেলার কিছু মানুষ ধুয়ো তোলে তারা এখানে প্রতিবছর কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তবে সেখানে বাংলা বই কত আদৌ বিক্রি হল, তা জেনেও না জানার মতো ভান করে তারা এ কথা বলেন। তবে বাংলাদেশের একুশে বইমেলার ব্যবসা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সহস্রাব্দের সূচনায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে খাতায় কলমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপন করার ডাক দিয়েছে। একযোগে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে, ভাষাপ্রেমী জনগণের কাছে যা প্রভূত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা দিনটিকে যথাযথ মর্যাদাসহ পালন করছি। নানা উৎসব-অনুষ্ঠান-সেমিনার-বক্তৃতা-কবিতা পাঠের আসর ইত্যাদির স্মরণে-বরণে। কিন্তু উত্তরণের পথ খুঁজি কতটুকু? বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে আমরা এখনও বাংলা ভাষায় ব্যবসায়িক ও দাফতরিক কাজ করতে দ্বিধা বোধ করি। আমরা উত্তর প্রজন্মকে শেখাই না শুদ্ধ বাংলায় একটা আবেদনপত্র লিখতে।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা তো বহুদূরের ব্যাপার। এখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। কীভাবে পারে? এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক পটভূমিকায় ক্রমশ পেছনে ফেলছে ভারতকে।

পশ্চিমবঙ্গ বহুভাষাভাষী ভারতের অংশ। কাজেই তাদের চলতে হবে সর্বভারতীয় ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশে জীবিকার জন্যে আসছেন অনেক ভিনদেশি নাগরিক। ব্যবসায়িক ও দাফতরিক কাজ বাংলায় চালু করলে ভিনদেশিদের জীবিকার প্রয়োজনে বাংলা শেখা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা ইংরেজি শিখব না, তা নয়, অন্যদের বাধ্য করব বাংলা ভাষা শিখতে। একেই বলে ভাষা আগ্রাসন। নিজের ভাষার প্রসারের জন্যে এটুকু আক্রমণাত্মক হতে বাধা কোথায়?

অমিত গোস্বামী : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper