ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নারী-শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ৯:৪৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০

আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি যেখানে প্রতিনিয়ত দুঃসংবাদের খবরই বেশি। সুখের চেয়ে দুঃখের বার্তা বেশি। আমাদের স্নেহ, মায়া-মমতা ভালোবাসা, বিবেক, মনুষ্যত্ব স্বার্থের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিজ পিতা ও ছোট শিশুকে হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে বা অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে বাবা তার শিশুসন্তানকেও হত্যা করছে। শুধু তাই নয় শিশু হত্যা, ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংতা বেড়েই চলেছে।

শিশুর প্রতি শারীরিক মানসিক নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। কখনো পারিবারিক কলহে শিশুকে হত্যা বা নির্যাতন, অপহরণ করা হয়। আবার কখনো প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে পিতা কর্তৃক নিজ সন্তানও হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। আসলে আমাদের অবসাদগ্রস্ত সমাজে বিবেক অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, কলহ প্রতিবেশীর ওপর মামলা-হামলার কারণে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে গিয়ে নিজের সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে- এমন ঘটনাও ঘটেছে।

শিশুনির্যাতন বা হত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিশুরা অধিকাংশ সময় পরিবার বা নিকটাত্মীয়ের ক্ষতির শিকার হয়েছে বেশি। কখনো সৎ পিতা মাতা বা চাচা, গৃহশিক্ষক, আবার কখনো প্রতিবেশী। অনেক সময় পরকীয়ার করনে নিষ্পাপ শিশু নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়। বিভিন্ন কারণে কোমলমতি শিশু হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩২৬ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জানুয়ারি মাসে ৩২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১৬ জন। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০ জন। ২৪ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ৮ জন। এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০ জন। এ ছাড়াও অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে ১৫টি। বিভিন্ন কারণে ৪০ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়।

শুধু শিশু হত্যা ও অপহরণই নয় নারী নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এ শব্দগুলো সভ্য দেশে যখন মানুষের মুখে মুখে তখন মনে হয় আমরা কোন সমাজে বাস করছি। এ সমাজ কি এখনো সভ্য হয়নি? সভ্যতার পাঠ গ্রহণ করেনি? স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ঘরে বাইরে গণপরিবহন অফিসে কোথায় নারীরা নিরাপদ? ধর্ষণ শব্দটি বারবার উচ্চারণ করাও লজ্জাকর। যে দেশে নারীরা আজ শিক্ষায় অগ্রগামী, সে দেশে আজ নারী নিরাপত্তা হুমকির মুখে কেন? কীভাবে দেশে আজ শিশু হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে।

দেশ সমাজ রাষ্ট্র একদিন ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে যার নমুনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা কোথায় যাচ্ছি। এ সমাজ একজন নারী, শিশুর নিরাপত্তা দিতে পারছে না। মনুষ্যত্ব, বিবেক, মনবিকতা ভূলুণ্ঠিত। এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি বগুড়ার গাবতলীর বারো বছরের শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী স্ত্রী। স্ত্রী রোকসানা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

এদিকে অপর এক ঘটনায় বগুড়ার কাহালুতে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু আলালকে হত্যা করে যতন চন্দ্র। আজকের সমাজে শিশু, নারী, ছাত্র-ছাত্রী কারো জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। আজ পিতার কোলে শিশুও নিরাপদ নয়। অথচ পিতা মাতার কোলই হচ্ছে শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কিন্তু সে জায়গা আজ অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। শিশুর হন্তারক একজন বাবা, শিশুর রক্তে রঞ্জিত একজন বাবার হাত ভাবতেও অবাক লাগে।

পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখভাল করার সার্বিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কেননা সমাজ, পরিবার রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। তাই সমাজে বসবাসরত মানুষের উন্নতি, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা মানুষের নিরাপত্ত নিশ্চিত করা সুকুমারবৃত্তিগুলোর মানবিক করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র অবশ্য এ দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনে তৎপর। মানবিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষার প্রসারও ঘটছে।

নারী শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার ও ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি টানছে। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশ নারী শিক্ষায় এগিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিককালে শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন যেন প্রতিযোগিতামূলকভাবে বেড়েই চলেছে।

দেশের সচেতন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- কোথায় যাচ্ছে আমাদের দেশটা। সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ কোথায়। সারা দেশে যেভাবে খুন, ধর্ষণ, পুড়িয়ে হত্যা, নারী নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধের সংখ্যা শুধু বেড়েই চলেছে। সভ্যতা বিবর্জিত বিষয়গুলো আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করছে। দেশে প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।

প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর আমাদের চোখে পড়ে। পিতা বা আপনজন কর্তৃক শিশু হত্যার ঘটনাও দুবৃত্তের দ্বারা শিশু ও নারী নির্যাতন ধর্ষণ ক্ষেত্র বিশেষে হত্যা যে ঘৃণ্য বর্বরতা স্পষ্ট হচ্ছে তা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি এর ভয়াবহতাও অকল্পনীয়।

আমাদের দেশে যেভাবে শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এগুলো রোধ করতে না পারলে আগামীতে বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তা এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা সমাজে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছাড়িয়েছে। আর এসব ঘটনা ঘটে কখনো বাসা বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘটছে।

নারী, শিশু ও ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি ধর্ষণ ও হত্যা, নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা ও তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা নতুন কিছু নয়। তবে এর নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। শুধু একজন নারী বা শিশুর ধর্ষণ হত্যার শিকারই হচ্ছে না, পুরুষের সেই হিংস্রতা রূপ নেয় হত্যাকাণ্ডে। অর্থাৎ ধর্ষণের পর হত্যা, নির্যাতনের পর হত্যা। পুড়িয়ে হত্যা।

কিন্তু কেন? কেন এমনটি হচ্ছে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের সচেতন মানুষের প্রশ্ন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা এ কোন সমাজে বাস করছি? তবে আশার কথা এই যে প্রধানমন্ত্রী শিশু ও নারী নির্যাতন ধর্ষণসহ যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। নুসরাত বা আবরার ফাহাদের ঘটনাই আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী নিজেই অপরাধীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে নুসরাত হত্যার রায় ঘোষিত হয়েছে। অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১৬ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন আদালত। এখন রায়টি দ্রুত বাস্তবায়িত হলে বা অপরাধীর শাস্তি যদি দ্রুত নিশ্চিত করা যায়, সমাজে তা দৃশ্যমান হয়, তাহলে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, নারী নির্যাতন অনেকটা কমবে বলে আশা করা যায়। তবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। নুসরাত হত্যার রায়ই তা প্রমাণ করে। আমরা আশা করি দ্রুত অপরাধীদের শাস্তি হবে।

শিশু ও নারী নির্যাতনে দেশের কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতন নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। এসব ঘটনায় কোনোটির বিচার হয়েছে আবার কোনোটির হয়নি। শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন, গণধর্ষণ বা নারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে তাতে যেকোনো বিবেকবান মানুষ বিচলিত না হয়ে পারে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ এসব ঘটনাগুলো নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন লেখালেখি হচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নারীবাদী বিভিন্ন সংগঠনগুলো এসব ঘটনার কথা নারী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ রোধ কল্পে তারা সভা সমাবেশ প্রতিবাদ করেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না নারী ধর্ষণ, নির্যাতনমূলক অপরাধ। একদিকে বিলম্বে বিচার অন্য দিকে অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতা অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার ঘাটতি।

প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত, বৈভব, রাজনৈতিক প্রতিপত্তির বাধাহীন বিস্তারের নেতিবাচক প্রভাবে আমাদের সমাজে নানা ধরনের অপরাধ ও অপকর্ম চলছে প্রতিনিয়ত। সীমাহীন নিষ্ঠুর বর্বরতার শিকার হচ্ছে শিশু ও নারী। ফলে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। শিশু ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন বন্ধ করতে না পারলে একদিন এ সমাজে মানুষের বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়বে। দ্রুত আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে নারীর মনে অভয় তৈরিতে নারী নির্যাতন রোধ করা এবং শিশুর বসবাসের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ ও সমাজ ব্যাবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। নইলে বর্তমান ও অনাগত প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।

তাই শিশু নারী নির্যাতন, হত্যার মতো বিষয়গুলো আমলে নিয়ে যারাই এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করা। সমাজে ক্রমাগতভাবে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। হেন কোনো অপরাধ নেই যে ঘটছে না। আজকের শিশু যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যত তেমনি নারী এ সমাজেরই অংশ। নারীকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ এগোতে পারে না। তাই সঙ্গত কারণে দেশ জাতির বৃহত্তম স্বার্থে সামাজিক অবক্ষয় রোধকল্পে এবং ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নারী ও শিশু হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ রোধ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : সহকারী শিক্ষক, চামরুল উচ্চ বিদ্যালয়, দুপচাঁচিয়া, বগুড়া

 
Electronic Paper