ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন

আবু আফজাল সালেহ
🕐 ৯:৩১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২০

‘বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,/ দেখে না যে বাণ ডেকেছে/ জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।/ ...আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।’ সবুজের অভিযান কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথের সুরে এ জন্য বলছি, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হবে। ইতোমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে। এ নিয়ে কিন্তু আমরা কমই কাজ করছি। পানি সংকট, জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। এটা কিন্তু আমাদের জন্য অশনিসংকেত।

বিভিন্ন রোগ (চর্মরোগসহ) আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের আলোচনা একেবারেই কম। ডেঙ্গুর দ্রুত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল পরিবর্তিত জলবায়ু। ক্যান্সার বা চর্মরোগের প্রকোপ বৃদ্ধিরও প্রধান কারণ পরিবর্তিত জলবায়ু। আমরা খাপ খাওয়াতে পারছি না! খাপ খাওয়ানোর আগেই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বা যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন রোগের বিস্তার বা প্রাদুর্ভাব ঘটছে। বাংলাদেশ, ভারতসহ এ এলাকায় ডেঙ্গুর দ্রুত বিস্তার বা ভয়াবহতা বাড়ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর খারাপ প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যর্থতায় আমাদের জন্য আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাবদিহি সংক্রান্ত দপ্তর (ইউএস গভর্নমেন্ট’স অ্যাকাউন্টাবিলিটি অফিস) ‘জলবায়ু পরিবর্তন : বৈশ্বিক অভিবাসনের সম্ভাব্য প্রভাব ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্থার ভূমিকা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৫ ভাগ বাড়তে পারে বা সমুদ্রের পানির উচ্চতা এক মিটার বাড়লে দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭.৫ ভাগ তলিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

‘বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন’ (ক্লাইমেট চেঞ্জ রিলেটেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ) শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন সূত্র অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৯৬ লাখ অভিবাসী তৈরি হবে।

এতে আরও বলা হয়, উষ্ণতা বাড়লে ঘূর্ণিঝড় বাড়বে। ফলে বাসস্থান, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। বৃষ্টিপাতের ধারা পরিবর্তন হয়ে খরা বেড়ে যাবে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানি বেড়ে গেলে ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। যার আলামত ইতোমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসন এখন বেঁচে থাকার সাধারণ কৌশল। যেমন অনেক কৃষক এখন লবণাক্ত পানির প্রভাবে নিজেদের চাষাবাদের কৌশল পাল্টেছেন। কেউ এখন লবণসহিষ্ণু ধান উৎপাদন করছেন, আবার কেউ ফসল ফলানো বাদ দিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। আর অনেকে গ্রাম ছেড়েছেন, জীবিকার আশায় পাড়ি জমিয়েছেন শহরে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট’ আর ‘সাসেক্স সেন্টার ফর মাইগ্রেশন রিসার্চ’ নামের দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন/ গবেষণা-প্রতিবেদন থেকে বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করেছে প্রতিবেদনটিতে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ফসলহানি হবে, পরিবেশ রিফিউজির সৃষ্টি হবে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-সাইক্লোনের প্রকোপ বেড়ে যাবে, অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হবে- সেটি বাংলাদেশের দোষে যতটা তার চেয়ে বেশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে। কিন্তু এ গ্রিন টেকনোলজির কনসেপ্টকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি ও টেকনোলজি অনুদান বা ধার হিসেবে আনতে হবে। অভ্যন্তরীণ স্থিতাবস্থা আনতে চাই ফান্ড। আর তা আদায়ে বিশ্ব ফোরামে নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হবে আমাদের।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি হবে। এর ফলে ঘটবে মাইগ্রেশন। কিন্তু এত মানুষের ঠাঁই হবে কোথায়? অব্যবস্থাপনা ও অদূরদর্শিতা, মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বন উজাড় হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরিত হচ্ছে নির্বিচারে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব, যথা- ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বাড়ছে। সিডর, আইলা ও ফণির নিষ্ঠুরতা সে কথাই প্রমাণ করে যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়-কবলিত বাংলাদেশের এসব প্রাকৃতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ ঠেকানোর ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। দুর্যোগ ঠেকাতে না পারলে জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি হবে। এবং তা হবে বিশেষভাবে উপকূলীয় নিচু অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। ভারত, বাংলাদেশ এবং বিশেষভাবে বিশ্বের দ্বীপ দেশসমূহের মানুষরা। এ তালিকায় মালদ্বীপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতো চরম হুমকির মুখে আছে।

জাতিসংঘের এক হিসাবমতে, যদি জলবায়ুর উষ্ণতা এ গতিতে বাড়তে থাকে, তা হলে সমুদ্র ও নদীর স্তর বৃদ্ধির ফলে কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হবে। এর কুপ্রভাব পড়বে ভারত এবং বাংলাদেশে। উপরন্তু ভারত/বাংলাদেশের মতো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর জন্য বিপদ আরও বেশি। উষ্ণতার এ হার যদি অব্যাহত থাকে, তবে মোট স্থলভাগের অনেক এলাকার ভূমি বিলীন হবে। ফলে তা সীমিত ভূমির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলবে। পুরো প্রভাব আরও ব্যাপক মরুময়তা, লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ রয়েছে আরও নানা আপদ।

জমির উর্বরতা হ্রাস পাবে। ফলে উৎপাদন কমে যাবে। অন্যদিকে রয়েছে অধিক জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ। সম্পদের সংকট আর জনসংখ্যার আধিক্য মিলে দেখা দেবে এক অপরিহার্য দুর্ভোগ। বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ থেকে এটা পষ্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা জাপানের মতো ধনী দেশগুলোর এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়তো তাদের খুব একটা গায়ে লাগবে না। কিন্তু দরিদ্র কোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির কথা একবার ভেবে দেখুন!

এ টাকা তাদের বার্ষিক জিডিপির একটি বড় অংশ। কাজেই তাদের অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে! আর ঘুরে-ফিরে সেই দেশের মানুষের ওপরই তো গিয়ে পড়ে সব ভোগান্তি। বছরের প্রায় দশ মাস গরম থাকা, শুধু গরম বললে ভুল হবে। তীব্র গরম। বছরে কোনো রকমে দুই মাস তাপমাত্রা একটু কম থাকে, যার মধ্যে এক মাসকে আমরা এখন শীতকাল বলে ধরে নিই। সেটি সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এক মাস পর শীত আসবে, অথচ তখনও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে।

বছরের মাঝখানে কারণে-অকারণে শুরু হয় অতিবৃষ্টি, যার ফলাফল হলো বন্যা। গত বছর যেমন শরৎকালেও ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এবার খুব ঘনঘন শৈতপ্রবাহ হয়েছে। এসব ঘটনাকে গবেষকেরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে দেখছেন। এসবের ফলে দেশে খাদ্য উৎপাদন কমছে, বাড়ছে নিত্যনতুন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অসুখ-বিসুখ। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা। ফলাফল হিসেবে শহরাঞ্চলে বস্তিবাসীর সংখ্যাও বাড়ছে।

আমরা কি এ সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি? কীভাবে সমস্যা মোকাবেলা করে টিকে থাকব, সেটা কি ভাবছি? ডারউইনের মতবাদ, যোগ্যতার জয়। ডারউইন মতবাদের একটি অংশ ‘যোগ্যদের জন্যই সব’। অযোগ্যরা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হবে। তাই যোগ্যতা আমাদের তৈরি করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা, কর্মকৌশল প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই সম্ভব। এ আশার আলো নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।

প্রথমে সমস্যার কারণগুলো শনাক্ত করতে হবে। তারপর কী কী করা যাবে না বা যাবে। ‘কীভাবে মোকাবেলা করা যায়’, ‘কার কী ভূমিকা হবে’ ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা জানি পরিবেশ দূষণ থেকেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে এবং পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুদূষণের জন্য কলকারখানা, বর্জ্য ইত্যাদি দায়ী। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে।

জলবায়ু উষ্ণায়নের জন্য বনভূমি উজাড়করণ দায়ী। আমরা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারছি কি? বৃক্ষরোপণে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি পরিমাণে। শিল্পকলকারখানার বিষয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে, যুগোপযোগী আইন/ নীতিমালা প্রণয়ন ও তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

ইটভাটা স্থাপনে বিশেষ শর্ত দিতে হবে। ডিজেলচালিত যানবাহনের প্রতি কঠোর শর্ত দিতে হবে। কারণ এখান থেকে বায়ুদূষণ হয়ে জলবায়ু উষ্ণায়ন হচ্ছে। প্রয়োজনে পরিবেশবান্ধব যানবাহন চালু করতে হবে। লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি বাতিল করতে হবে। জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে জলবায়ুর বিষয়ে নিবিড় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভা, সেমিনার করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার করতে হবে। বিজ্ঞাপন আকারের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে আর্টিকেল/ ফিচার প্রকাশ করতে হবে।

মানবজাতি উন্নতির চরম শিখরে অবস্থান করলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে।

আবু আফজাল সালেহ : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper