যুবারা সিনিয়র হয়েও জিতুক বিশ্বকাপ
সাহাদাৎ রানা
🕐 ৭:৫৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০
অবশেষে স্বপ্নের বিশ্বকাপ জিতল বাংলাদেশ। তবে বড়দের হাত ধরে নয়, বিশ্বকাপ এসেছে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মাধ্যমে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে বৃষ্টি আইনে ৩ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো ইভেন্টে শিরোপার স্বাদ পেল টাইগাররা।
তবে ম্যাচটি অন্য সব ম্যাচ থেকে বিভিন্ন কারণে ছিল আলাদা। কারণ অতীতে দেখা গেছে জয়ের কাছাকাছি গিয়েও আমরা বারবার ব্যর্থ হয়েছি শেষ হাসি হাসতে। বিশেষ করে সিনিয়ররা এমন উদাহরণ তৈরি করেছেন অসংখ্যবার। এবারও তেমন কিছুর সম্ভাবনাও জেগে উঠেছিল। কারণ এ অনূর্ধ্ব-১৯ দলেরও এমন অভিজ্ঞতা ছিল গতবার।
এ ভারতের কাছে কাছেই হেরেছিল শেষ মুহূর্তে গিয়ে। এবার সেই ভারতের বিপক্ষে তেমন কিছুর সম্ভাবনা তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত আর তেমনটি হয়নি। এবার আর কোনো ভুল করেনি বাংলাদেশের যুবারা। ঠাণ্ডা মাথায় দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গেছেন অধিনায়ক আকবর আলী। যেখানে তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন সতীর্থদের।
এমন জয়ের মাধ্যমে যুবারা এটা প্রমাণ করেছে তারা আর তীরে এসে তরি ডোবাতে আগ্রহী নয়। নতুন প্রজন্মের এমন বার্তা আমাদের দেশের ক্রিকেটের জন্য অবশ্যই সুখবর।
এবার মূল বিষয়ে প্রবেশ করা যাক। আমাদের দেশে ক্রিকেটের একটি কমন প্রশ্ন বা শঙ্কার বিষয় হলো ক্রিকেটের পাইপলাইন নিয়ে। তবে এবার অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ জিতে অবশ্য সেই শঙ্কা কিছুটা কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সিনিয়রদের ব্যর্থতাও আমাদের সেই শঙ্কার বিষয়টি সামনে বারবার নিয়ে আসছে। অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ জিতলেও বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন পাইপলাইনে মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত ক্রিকেটার নেই। যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য একটা হুমকি।
এ বিষয় নিয়ে আলোচনা বর্তমান সময়ে একটি অতি কমন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলোচনাটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে হয়তো কারও দ্বিমত থাকতে পারে তবে বিষয়টি দেশের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর ভবিষ্যৎ বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবার ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে বিষয়টির ওপর একটু আলোকপাত করা যাক।
একটা দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সে দেশের উঠতি ক্রিকেটারদের পাইপলাইন কতটা শক্তিশালী বা সমৃদ্ধ তার ওপর। পাইপলাইনের ওপর নির্ভর করে তারা তাদের ভবিষ্যৎ ক্রিকেট নিয়ে কতটা ভাবছে। আগামীতে সে দেশ ক্রিকেট বিশ্বে কতটা রাজত্ব করবে তারও পূর্বাভাস পাওয়ার সঙ্কেতের নাম ‘পাইপলাইন’।
এ কারণে দেখা যায় যেসব ক্রিকেট দল প্রভাবশালী তারা দীর্ঘদিন ধরে আগে থেকেই তাদের পাইপলাইন নিয়ে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে। ক্রিকেটের পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে পরিষ্কার বোঝা যায় তারা পাইপালাইন নিয়ে কতটা সচেতন। সচেতন বলেই দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট বিশ্বে তাদের রাজত্ব চলমান। পাইপলাইনকে কাজে লাগিয়ে এর ফলাফলও তারা পেয়ে যায় প্রত্যাশা অনুযায়ী। শুধু ক্রিকেট নয়, যে কোনো খেলাধুলার ক্ষেত্রে পাইপলাইনে কী পরিমাণ খেলোয়াড় আছে তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে খেলে ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাত্রা শুরু করে। এর প্রায় চৌদ্দ বছর পর ২০০০ সালে টেস্ট ময়দানে পদার্পণ টাইগারদের। ওয়ানডের হিসেবে সময়টা ৩৪ বছর। সময়ের হিসেবে কিন্তু কম নয়। তবে টেস্টের হিসেবে প্রায় ২০ বছর।
এখন প্রশ্ন হলো এ সময়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ কি তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন ক্রিকেটার উপহার দিতে পেরেছে? পারলেও কতটা সফল বাংলাদেশ? এর উত্তর অবশ্য মোটা দাগে দেওয়া কঠিন। তবে বাস্তবতা হলো ১৯৮৬ সালে ওয়ানডে খেলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাত্রা শুরুর পর থেকে নিয়মিতভাবেই নতুন নতুন ক্রিকেটার এসেছে এবং এখনও আসছে নতুন নতুন ক্রিকেটার। তবে প্রসঙ্গটা অন্য জায়গায়। প্রসঙ্গটা মানসম্পন্ন ক্রিকেটারের বিষয়ে।
১৯৮৬ সালের পর ২০০০ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ ক্রিকেটার এসেছে তা ছিল সেই সময়ের বিবেচনায় প্রত্যাশিত। নবীন একটা দল হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে সে সময় প্রতিনিয়ত শিখেছে বাংলাদেশ। সে সময় ক্রিকেটার পাওয়া নিয়ে অর্থাৎ জাতীয় দল গঠন নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবতে হয়নি নির্বাচকদের। তবে ধীরে ধীরে সেই অবস্থা থেকে মনে হয় কিছুটা সরতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু টেস্ট ট্যাস্টাস পাওয়ার পর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই অর্থে টেস্ট ক্রিকেটার উঠে আসেনি। এখন প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রিকেটার পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। ২০ বছরের পথ চলায় যা পর্যাপ্ত নয়। আর বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে গত দুই তিন বছর ধরে যা অপর্যাপ্ত।
বর্তমানে বাংলাদেশে সে অর্থে কোনো ‘এ’ নেই। কয়েক বছর আগে ‘এ’ দল থাকলেও এখন ‘এ’ দলের বিকল্প হিসেবে আছে হাই-পারফরম্যান্স দল। যাকে ‘এ’ দল হিসেবে গণ্য করা হয়। অনূর্ধ্ব-১৯ আর ‘এ’ দল বিবেচনায় বাংলাদেশের পাইপলাইনে অনেক ক্রিকেটার আছেন। এবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে একঝাঁক নতুন উদীয়মান ক্রিকেটারও পেলো বাংলাদেশ। এখন বিষয় হলো তাদের যথাযথ পরিচর্যা করার বিষয়টি।
এ শিরোপা জয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দল গড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন কাব্য। যে ইতিহাস এর আগে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়ের দল কোনো দিন করতে পারেনি। সেই ইতিহাসই গড়েছে আকবর আলীর দল। যা বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। এমন বড় প্রাপ্তিটা এসেছে ছোটদের মাধ্যমে। তাই আলোচনাটাও একটু বেশি তাদের ঘিরে। এখন প্রশ্ন এসেছে, ছোটরা পারলে বড়রা কেন পারবে না। নতুনদের নিয়ে তাই এখন প্রত্যাশার জায়গাটাও তৈরি হয়েছে আরও বেশি।
এখন প্রত্যাশা আগামীতে সিনিয়র হয়ে এ যুব বিশ্বকাপজয়ী যুবারা বড়দের বিশ্বকাপ জিতবে। এর জন্য নিতে হবে এখন থেকেই উদ্যোগ। উদ্যোগটা নিতে হবে এ কারণে, আমাদের বদনাম রয়েছে অনূর্ধ্ব পর্যায়ে ভালো খেললেও এরপর আর সেভাবে সেই ক্রিকেটারদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয়। অনেকাংশে সত্য। অতীত ইতিহাস অন্তত তাই বলে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হলো অনূর্ধ্ব পর্যায়ে কোনো ক্রিকেটার একটু ভালো করলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই তরুণ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। কারণ এখানে নিজেকে বড়দের বা জাতীয় দলের জন্য সে সেভাবে তৈরি করেনি। আমরা না বুঝে তাকে সুযোগ করে দিয়ে তাকে ধ্বংস করে দিই।
আমাদের ক্রিকেটে এমন উদাহরণ অসংখ্য। অথচ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড শুরুতে নতুন ক্রিকেটারদের সেভাবে সুযোগ দেয় না। এসব দেশ নতুনদের পারফরম্যান্সের পাশাপাশি নতুনদের মানসিকভাবে তৈরির সময়টাও দেয়। যাতে জাতীয় দলে গিয়ে টিকে থাকে দীর্ঘদিন যা আমরা করি না।
আমরা একটা বা দুটো সুযোগ দিয়ে তার ক্যারিয়ার শেষ করে দিই। তাই এখন আমাদের বোর্ডের উচিত হবে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের কোনো সদস্যকে খুব দ্রুত জাতীয় দলে সুযোগ না দিয়ে আরও সময় নিয়ে তাদের যথাযথভাবে তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। যাতে তারা জাতীয় দলে এসে একটি বা দুটি ম্যাচ খেলে ব্যর্থ হয়ে ঝরে না পড়ে। তারা যেন দীর্ঘদিন জাতীয় দলকে সাপোর্ট দিতে পারেন।
এখানে আমাদের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯ দল বিশ্বকাপ জিতেছে। দলের সবার মধ্যে বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যা আগে আমাদের আর কোনো ক্রিকেটারের ছিল না। এখন যদি এসব ক্রিকেটারকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করা সম্ভব হয় তবে আকবর-শাহাদাতরা একদিন জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতবে। কেননা, তারা যখন আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন তখন তাদের প্রধান টার্গেটই থাকবে বিশ্বকাপ জয় করা। যা তারা ইতোমধ্যে করেছে।
এসব ক্রিকেটার বিশ্বকাপ জয় করা ছাড়া আর কিছু ভাববেও না। এখন এসব ক্রিকেটারকে যথাযথ পরিচর্যা করার প্রধান দায়িত্ব বোর্ডের। এসব ক্রিকেটার যেন হারিয়ে না যায়। কারণ তাদের হাত দিয়েই আগামীতে আসবে বড়দের বিশ্বকাপ।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
[email protected]