সীমান্ত হত্যা বন্ধ হোক
অমিত গোস্বামী
🕐 ৯:০০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২০
‘সীমান্ত বড় অসহিষ্ণু, সীমানা সৃষ্টি করে বোধ হিংসার,/ যেন এ মাটি আল্লাহর নয়, যার জোর তার!/ তাই সীমান্তহীনতা চাই।’ তীব্র ক্ষোভে কবিতাটি লিখেছিলাম ২০১১ সালের শুরুতেই যখন বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে পনের বছর বয়সের ফেলানী খাতুন বিএসএফের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পাঁচ ঘন্টা লাশ হয়ে ঝুলে ছিল কাঁটাতারের ওপরে। নয় বছর অতিক্রান্ত।
বৃহস্পতিবার আবার নয় বছর বাদে খবর পেলাম গত দুই তিন দিনে বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে অন্তত পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। গত বছর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পদ্মা নদীতে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে এক বিবাদ ও গোলাগুলির ঘটনায় এক ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী নিহত হন। নাম নিহত বিএসএফ সদস্যের নাম বিজয়ভান সিং। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন একে ‘অনাকাক্সিক্ষত এক দুর্ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেন।
ক্রমেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চল হয়ে উঠেছে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাণঘাতী সীমান্ত। কেননা, সংখ্যার দিক থেকে সীমান্তে প্রাণহানিতে বিশ্ব রেকর্ডটি আমাদেরই। আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে হতাহতের সবাই না হলেও অন্তত ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশি। সামগ্রিকভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় সন্দেহভাজনদের হত্যার বিষয়টিকে যে সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, সেটা আমরা আজও বুঝিনি। জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুসারে, ২০১২ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৩৫ জনকে।
২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে। ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫ জন বাংলাদেশিকে। ২০১৬ সালে ৫৮ জন এবং ২০১৭ সালে ২৯ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে সীমান্তে এমন প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ১৪ জন। ২০১৯ সালে ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী- বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৩৮ জন বাংলাদেশি। আটক হয়েছে আরো ৩৪ জন।
কিন্তু কেন এ হত্যালীলা? ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত ৪০৯৭ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ২২১৭ কিলোমিটার, আসামের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার ও মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৭৮১ কিলোমিটার নৌ-সীমান্ত রয়েছে।
এ দীর্ঘ স্থলসীমান্ত পাহারা দেয় ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সংখ্যায় কত তারা? নিয়োজিত প্রায় ৭০ টি ব্যাটেলিয়নের ৪৯০০০ জওয়ান।
১৯৫০ সালে নেপাল এবং ইন্ডিয়ার মাঝে ‘ইন্দো-নেপাল পিস অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি’র কারণে নেপাল এবং ইন্ডিয়ার জনগণ কোনো পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে পারাপার করতে পারে। সেখানে সীমান্ত নিয়ে এ উগ্রতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে সীমান্ত নিয়ে এ কড়াকড়ি কেন? যে যুক্তিগুলো ভারতীয় মহল থেকে উঠে এসেছে সেগুলি হলো- চোরাচালান, মানবপাচার, মাদকদ্রব্য চোরাচালান, জাল নোট পাঠানো, সীমান্তকে কাজে লাগিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ।
আসুন, এগুলোর একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
চোরাচালান কী হয়? মূলত চিনি, গরু, ওষুধ, ফল, কিছু চাল, ভারতীয় শাড়ি, কখনও কখনও সোনা। চিনি, ওষুধ, ফল উৎপাদনতো পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে হয় না। অবাধ আগমন বা শুল্কযুক্ত হয়ে এ রাজ্যগুলোতে চিনি, ওষুধ, ফল এলে তার দাম অবশ্যই অনেক বেশি হত। স্বাভাবিক কারণে বিযুক্ত ভূখণ্ড বাংলাদেশে এ জিনিসগুলোর দাম তুলনামূলক বেশি। কাজেই অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী এ চালান অবশ্যম্ভাবী।
এবার আসি গরু প্রসঙ্গে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু পাচার বন্ধে বিএসএফ-কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারপর এ গরু পাচারের নিম্নগতি। এর আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ থেকে ২২ লাখ গরু আসত। আর গত বছরে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ। এবার আসি মানবপাচার সম্পর্কে। কাজের সন্ধানে, আয়ের সন্ধানে, স্বাচ্ছল্যের সন্ধানে এ অভিগমন প্রাচীনকাল থেকেই আছে।
উন্নত দেশে যাওয়া ও সেখানে বসবাসের চেষ্টা মানুষের মধ্যে চিরকালীন। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো, এ কথা সচেতন যে কোনো মানুষই স্বীকার করবেন। কাজেই এখন অর্থনৈতিক কারণে কেউ বাংলাদেশ থেকে পারাপার করেন না।
একসময় ভারত থেকে বাংলাদেশে কাশির ওষুধ ফেন্সিডিল বাংলাদেশে যেত। এখন ফেন্সিডিলের কম্পোজিশন পাল্টে যাওয়ায় ওষুধটি আর নেশার ওষুধ নেই। তাই যায় না। এখন মিয়ানমার হয়ে ঢোকে ইয়াবা। বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বেড়ে গেছে এটা মেনে নিয়ে বলা যায় যে এদের আটকাতে সীমান্ত পাহারা কি খুব কাজে লেগেছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে? তাই যদি হত তাহলে সীমান্ত পাহারা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আসার আগে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সন্ত্রাসীদের তুমুল উপদ্রব ছিল কী করে? তারা অবাধে তাদের কার্যকলাপ ভারতীয় ভূখণ্ডে করে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের ডেরায় ফিরে আসত। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান শাসক দল ক্ষমতায় এসে সন্ত্রাসের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ফলে সে সব সন্ত্রাস দ্রুত শূন্য হয়ে গেছে। কাজেই এ সকল চিত্র থেকে একটা কথা পরিষ্কার হয় যা তা হলো সীমান্তে যা ঘটে সেটা যাতায়াত। একতরফা অনুপ্রবেশ নয়।
চোরাচালান ততটা নেই সাধারণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য জিনিসপত্র ছাড়া। গরু পাচারও প্রায় নেই। তাহলে যারা যাতায়াত করে তারা কারা? নিতান্তই এপার-ওপারের আমজনগণ যাদের বুকের মাঝখান দিয়ে হয়েছে বিভাজন। নিতান্তই আত্মীয়তার টানে, চিকিৎসার প্রয়োজনে বা সামাজিক কারণে তারা সীমানা অতিক্রম করেন। কারণ নিয়মনীতির গ্যাঁড়াকলে যাতায়াত মসৃণ নয়। পাসপোর্ট, ভিসার চক্করে সীমান্তের মানুষ বারে বারে রাজধানীতে গিয়ে তুমুল ব্যয় করে যাতায়াতের অনুমতি নেবেন এটা আশা করা বাতুলতা।
এবার দেখা যাক, এ সীমান্তরক্ষীরা করে কী? আমি দেখেছি হলদিবাড়ি-বেরুবাড়ির বেশ কিছু এলাকায় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই। শিলিগুড়ি লাগোয়া ফুলবাড়ি এবং ফাঁসি দেওয়ার বেশ কিছু এলাকাতেও কাঁটাতারের বেড়া নেই। জিরো পয়েন্টের পাশ দিয়ে মহানন্দা নদী বয়ে যাওয়ায় বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। জলাভূমি থাকায় যেখানে বেড়া লাগানো সম্ভব নয়। উত্তর ২৪ পরগনার টাকিতে নদী বয়ে গেছে। কাজেই কাঁটাতার দেওয়া সম্ভব নয়। এ এলাকাগুলো সীমান্তরক্ষীদের তাণ্ডবের লীলাভূমি। সীমান্তরক্ষীরা যা যা করে তা হল-
১. সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো (বিএসএফ এবং বিজিবি) টাকা নিয়ে নিজেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মানুষ পার করে তাদের দালালদের মাধ্যমে। দরিদ্র মানুষগুলো সম্পূর্ণ অবৈধ অবস্থায় বিপজ্জনকভাবে সীমানা পাড়ি দেয়।
২. সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো (বিএসএফ এবং বিজিবি) টাকা নিয়ে গরু পাচারে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে।
৩. গ্রামবাসীর সঙ্গে বিএসএফের খারাপ ব্যবহার, নারী নির্যাতন, অকথ্য গালিগালাজ থেকে শুরু করে অযথাই মারধর করা থেকে শুরু করে আরও অনেক ধরনের অভিযোগ আছে।
২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ শিরোনামে বিশদ আকারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ শতকের প্রথম ১০ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন এক হাজারের মতো বাংলাদেশি, যার অর্থ হচ্ছে গড়ে প্রতিবছর ১০০ জন অর্থাৎ প্রতি সাড়ে তিন দিনে একজন করে বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতেও যেমন বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিকরা এর ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।
কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা ফেলানীর নিথর দেহের ছবি সাময়িকভাবে আমাদের কিছুটা বিচলিত করলেও সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে সবাই ব্যর্থ হয়েছেন।
অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রস্তাব দিয়েছে যে অনুপ্রবেশ রুখতে ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের মানুষদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট চালু করা হোক। গরু পাচার রোধে সীমান্ত হাটগুলোর মাধ্যমে গরু রপ্তানির জন্যও প্রস্তাব দিয়েছে তারা। তারা আর একটি প্রায় বৈপ্লবিক প্রস্তাব দিয়েছে- ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া ৩০ কিলোমিটার এলাকাকে বিশেষ সীমান্ত অঞ্চল হিসাবে গড়ে তোলা হোক। দ্বিদেশীয় সীমান্ত অঞ্চল বা বি বি জেড-গুলোকে বিশেষ আর্থ সামাজিক এলাকা বলে ঘোষণা করা হোক আর দুই দেশের যৌথ প্রশাসন চলুক সেখানে। তবে ওই বিশেষ এলাকায় কোনও দেশকেই তাদের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতে হবে না।
প্রস্তাবটি মন্দ নয়। অত্যাচারী সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে স্বসম্মানে বিদায় করে ভিসা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে মুক্ত গতায়াতের ব্যবস্থা না করলে মানুষ হত্যা, পারস্পরিক বিদ্বেষ, সন্ত্রাস রোধ কিছুই করা যাবে না। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারকে আজ এটা বুঝতে হবে, দু’দেশের অনেক মানুষ এ সীমান্ত তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। নেপালের মতো বাংলাদেশও ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র। অতএব সীমান্তের বেড়া বিদায় করে অবিলম্বে দুই দেশের মধ্যে মুক্ত যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। কারণ মানুষ বিশ্বাস করেন- ‘দেশ যদি গণ্ডিবদ্ধ আমি তবে সীমান্ত মানি না’।
অমিত গোস্বামী : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]
[মতামত লেখকের নিজস্ব]