ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাণিজ্য মেলায় প্রতারণা

সাহাদাৎ রানা
🕐 ৮:৪৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২০

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা মানেই দেশ বিদেশের মানসম্পন্ন পণ্যের সমাহার। যেখান থেকে ক্রেতা তার পছন্দের জিনিস কিনে নেন। সেই পণ্য কিনতে আসেন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ক্রেতা। এর মূল লক্ষ্য এক দেশের পণ্য অন্য দেশের ক্রেতার কাছে পরিচিত করে তোলা। বিদেশি ক্রেতারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা থেকে কাক্সিক্ষত পণ্য পছন্দ করে রপ্তানির আদেশ দিয়ে থাকেন।

এর ফলে আমাদের দেশের পণ্যের প্রচার ও প্রসার সম্ভব হয় বেশি করে। এ কারণে রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পায়। শুরু থেকে বাণিজ্য মেলার অর্থ এমন হলেও দিন দিন সেই ঐতিহ্য যেন হারাতে বসেছে। এখন ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা নিয়ে উঠছে নানান অভিযোগ আর প্রশ্ন।

বিশেষ করে বিদেশি পণ্যের নামে দেশি পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। যা এক কথায় প্রতারণা। কিন্তু সেই প্রতারণা যেন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। ফলে ঢাকা আন্তর্জাতিক মেলা তার নিজস্ব মান হারাচ্ছে। সবদিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরু হয়েছে নতুন বছরের প্রথম দিন। সংখ্যার হিসেবে এবারের মেলা ২৫তম। বয়সের হিসেবে প্রাপ্তবয়স্কও বলা যায়। আরও সহজভাবে বলা ২৫ বছরের অভিজ্ঞ। সময়ের হিসেবে ধীরে ধীরে মেলার পরিসর বেড়েছে, বেড়েছে মেলায় স্টলের সংখ্যাও। সেই ধারাবাহিকতায় বেড়েছে ক্রেতার সংখ্যাও।

যেখানে মেলা চলাকালে প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতার সমাগম ঘটে। বরাবরের মতো ক্রেতার উপস্থিতির ক্ষেত্রে কোনো কমতি নেই এবারও। মেলা চলাকালে নিজের পছন্দের পণ্যটি কিনতে তাই ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। ক্রেতাদের চাহিদা বা দাবির মুখে সম্প্রতি মেলার সময়সীমা কয়েকদিন বাড়ানো হয়েছে। সময়সীমা বাড়ানো হলেও এবারের মেলায় বাড়ানো হয়নি পণ্যের মান। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে মানহীন পণ্যের অভিযোগ উঠেছে এবারের মেলাকে ঘিরে।

আন্তর্জাতিক মানের মেলা হলেও সেখানে মিলছে মানহীন পণ্য। বলা যায় প্রতারণার নতুন ফাঁদ যেন বাণিজ্য মেলা! বিক্রেতারা আসল পণ্যের নামে নকল পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। দুঃখজনক খবর হলো, এক দেশের নামে বরাদ্দ দেওয়া প্যাভিলিয়নে বিক্রি হচ্ছে অন্য দেশের পণ্য। বিদেশি নামের এসব স্টলে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে দেশি পণ্যও। বিশেষ করে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রির অভিযোগও রয়েছে।

সবচেয়ে শঙ্কার জায়গাটা হলো, এবারের মেলায় পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে শুরু থেকেই বিভিন্ন অফার দেওয়া হচ্ছে। প্রতিবারই অবশ্য দেওয়া হয়, তাই এবারও বিভিন্ন অফার রয়েছে। তবে এবার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে অফারের ক্ষেত্রে।

সাধারণত মেলার শেষ দিকে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে সামান্য ছাড় দেওয়া হতো। কিন্তু এবারের মেলায় শুরু থেকে অফারের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন স্টলে রয়েছে একটি কিনলে আরও একটি ফ্রি-র অফার। এ ছাড়া রয়েছে নগদ মূল্য ছাড়। শুধু তাই নয়, পণ্য কিনলে মিলছে ক্যাশব্যাকও। এসব ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্য। বিশাল ছাড়ের অফার দিয়ে প্রকারান্তরে ক্রেতাদের কৌশলে নিম্নমানের পণ্য দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে।

এসব প্রতারণা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ক্রোকারিজ ও কসমেটিকস পণ্যের ক্ষেত্রে। যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্রেতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। আর এ সুযোগই নেন কিছু অসাধু বিক্রেতা। ক্রোকারিজ ও কসমেটিকস ছাড়া অন্য পণ্যের ক্ষেত্রেও এমন অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়। ব্যবসায়িক কারণে অফার বা ছাড় দেওয়ার বিষয়টি ঠিক আছে, কিন্তু অতিরিক্ত অফার প্রতারণার সামিল। সেই কাজটি দিন দিন করে যাচ্ছে কিছু ব্যবসায়ী। বিশেষ করে মেলার পুরো সময়ে এমন অফার অগ্রণযোগ্য। এটা একটি আন্তর্জাতিক মেলার সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না।

আরও একটি বিরাট অভিযোগ রয়েছে এবারের মেলাকে কেন্দ্র করে। সাধারণত আমরা দেখি, ফুটপাতে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য একদাম ১০০ টাকা বা একদাম ২০০ টাকা বলে দাম হাঁকেন বিক্রেতা। এসব দৃশ্য ঢাকার রাস্তার পাশে ফুটপাতে দেখে অভস্ত সাধারণ জনগণ। কিন্তু এবার আর ফুটপাত নয়, সেই চিত্র দেখা গেছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায়।

আন্তর্জাতিক মানের একটি মেলার ক্ষেত্রে কীভাবে এটা সম্ভব সেই প্রশ্ন সবার। বিশেষ করে যখন এখানে দেশ বিদেশের হাজারো ক্রেতা আসেন। এমন চিত্র দেখে তারা আমাদের দেশের বাজার সম্পর্কে আর যাই ভালো কোনো ধারণা নেবেন না। এ বিষয়ে মেলা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল শুরু থেকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে উদাসীনতা লক্ষ করা গেছে।

এবারের মেলায় আরও একটি বিষয় সবার সামনে উঠেছে, সেটা হলো নিউমার্কেটের পণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে অধিকাংশ স্টল। দামের ক্ষেত্রে বেশি নেওয়া হচ্ছে নিউমার্কেটের তুলনায়। এমন অভিযোগ অধিকাংশ ক্রেতার। কারণ যেসব পণ্য ক্রেতারা নিউমার্কেটে পেয়ে থাকেন সেই পণ্যই মিলছে মেলায়। যদি একই পণ্য মাকের্টে পাওয়া যায় তবে মানুষ টিকিট কেটে কেন মেলায় যাবে। টিকিট নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। কারণ অব্যবস্থাপনা। মেলায় প্রবেশ মূল্য বাড়ানো হলেও সেবার মান সে অর্থে বাড়েনি। বরাবরের মতো এবারও ভেতরে বিশ্রামের জায়গা রাখা হয়নি।

অনেকে মেলায় দীর্ঘ সময় ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান না। খাবারের অতিরিক্ত দামের অভিযোগ তো অনেক পুরনো। নিম্নমানের খাবার দিয়ে বেশি দাম রাখা যেন বাণিজ্য মেলার স্বাভাবিক চিত্র। তাই এখন মানুষজন বাধ্য না হলে খাবারের দোকানের দিকে দৃষ্টি দেন না ভয়ে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাসমান বিক্রেতা দেখা যেত মেলায়। এবারও তেমন বিক্রেতার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

ভাসমান বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে মেলায় প্রবেশ করে পণ্য বিক্রি করছে, যা আন্তর্জাতিক মানের মেলার সঙ্গে কোনোভাবেই মানানসই নয়। পূর্বে বিভিন্ন সময়ে নানান অভিযোগে বিভিন্ন স্টলে জরিমানা করার খবর প্রমাণ করে যেসব অভিযোগ উঠেছে তা সত্যি। কিন্তু কেন আন্তর্জাতিক মানের একটি মেলার ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ উঠবে। যেখানে হাজার বিদেশি ক্রেতা আসেন। এসব বিদেশি ক্রেতার কাছে এমন তথ্য যাওয়া আমাদের জন্য সুখকর নয় কোনোভাবেই।

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রতারণার অভিযোগ যে মিথ্যে নয় তার বড় প্রমাণপত্র হলো জরিমানা করার অসংখ্য উদাহরণ। ইতোমধ্যে মিথ্যা বিজ্ঞাপন, অতিরিক্ত মূল্য আদায়, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি ও ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে মেলায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে।

মেলা প্রাঙ্গণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের অস্থায়ী কার্যালয় এসব জরিমানা আদায় করে। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতাদের কিছুটা দায় রয়েছে। বেশির ভাগ ক্রেতা জানেন না বিক্রেতা প্রতারণা করলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। অনেকে জানলেও অভিযোগ করেন না।

ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে যান। এ সুযোগটাই নেন কতিপয় অসাধু প্রতিষ্ঠান। তাই ঝামেলা মনে না করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরে অভিযোগ করতে হবে প্রতারকদের বিষয়ে। শুধু নিম্নমানের পণ্য দিয়ে প্রতারণা নয়, বাণিজ্য মেলায় ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ায় ঘটনাও ঘটছে।

চলমান ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় কয়েকটি স্টলকে এর জন্য জরিমানা করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা পণ্য বিক্রির সময় ভ্যাট চালান ইস্যু করেন না। অথচ ভ্যাট আইনে যা স্পষ্ট লেখা রয়েছে ভ্যাট চালান ইস্যু করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের একটি মেলার ক্ষেত্রে ভ্যাট ফাঁকির মতো ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আরও দুঃখজনক হলো ভ্যাট ফাঁকির তালিকায় রয়েছে ক্রোকারিজ থেকে শুরু করে খাবারের নামিদামি দোকান পর্যন্ত। ভ্যাট যেন ফাঁকি দিতে না পারেন সে জন্য ক্রেতাকে আরও সচেতন হতে হবে। নিজে থেকে ভ্যাট চালানের রশিদ চাইতে হবে ক্রেতাকে। যদি বিক্রেতা তা দিতে অস্বীকার করেন তবে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদফতরে অভিযোগ করতে হবে।

একটা সময় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা মানেই ছিল সব ক্রেতার কাছে ছিল বিশেষ কিছু। তবে এখন আর তেমনটি নেই। বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন কারণে ক্রমেই রঙ হারিয়ে সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাণিজ্য মেলার। বাণিজ্য মেলা এখন শুধু নামেই ‘আন্তর্জাতিক’। মানের দিক দিয়ে সেখানে আন্তর্জাতিকের ছোঁয়া হারাতে বসেছে। এখানে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাধারণত পৃথিবীর কোথাও পণ্য প্রদর্শনীর সময়কাল এক সপ্তাহের বেশি হয় না। আরও মজার তথ্য হলো, সেখানে কোনো পণ্য বিক্রিও করা হয় না। শুধু ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনের পণ্য পছন্দ করে পণ্যের ক্রয়াদেশ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা কিছুটা ব্যতিক্রম। আমাদের বাণিজ্য মেলা হয় মাসব্যাপী, যেখানে পণ্য বিক্রিও করা হয়। পণ্য বিক্রি দোষের কিছু নয়। তবে এখানে মানসম্পন্ন পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে কি-না সেটাই প্রশ্ন।

বাস্তবতা হলো, ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অনেক মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু কিছু প্রতারকের প্রতারণার কারণে মানসম্পূর্ণ পণ্যগুলো আড়ালে পড়ে থাকে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এবারের মেলা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তাই এবার যেসব বিষয়ে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে, আগামীতে তা অবশ্যই দূর করতে হবে।

বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তাদের স্টল বরাদ্দ আগামীতে বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই আগামীতে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার স্বাদ পাবে সবাই। ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে শুরু করে সবার জন্যই তা হবে সুখকর।

সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক
[email protected]

 
Electronic Paper