ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সরকারের বেশি ব্যাংক ঋণ উদ্বেগজনক

এম এ খালেক
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৫, ২০২০

রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক না হওয়া, সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া এবং অন্য কোনো বিকল্প উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারার কারণে সরকার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিং সেক্টরের ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হলে আগামীতে সরকার সরকারি প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

তারা মনে করছেন, অর্থায়নের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে বর্তমানে যে মন্দাভাব বিরাজ করছে তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তেমন একটা পড়েনি। কারণ সেই সময় বাংলাদেশ তার রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছিল। কারণ সেই সময় অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারের কারণে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন থেকে শুরু করে অনেক দেশের পণ্য রপ্তানি কমে গিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে। কারণ চীন ও এ ধরনের অন্যান্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সাধারণত আপার এন্ডের তৈরি পোশাক রপ্তানি করত। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের ভোগ ব্যয় এবং ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য কমে গিয়েছিল। তাই তারা লোয়ার এন্ডের তৈরি পোশাক ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এটা আমাদের মতো দেশের জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছিল। কারণ বাংলাদেশ মূলত লোয়ার এন্ডের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি সেই সময় না কমে বরং বেড়ে গিয়েছিল।

উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মূলে কাজ করছে তৈরি পোশাকসামগ্রী। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক রপ্তানি করা হয় তার বেশিরভাগ, প্রায় ৮৫ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের স্থানীয় অর্থনীতিতে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু এবারের অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম।

এবারের যে অর্থনৈতিক মন্দার তার সূত্রপাত হয়েছে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য নিয়ে। কাজেই তার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও তুলনামূলকভাবে বেশি হারে আঘাত করছে। গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ৪ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করেছিল। এটি ছিল রপ্তানি ক্ষেত্রে একটি বিরল রেকর্ড। কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ে ব্যবধানে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেগেটিভ ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর কখনোই রপ্তানি বাণিজ্যে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হয়নি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস এখনো রপ্তানি বাণিজ্য। যদিও এ খাতে যে অর্থ উপার্জিত হয় তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিতে চলে যায়। পণ্য রপ্তানি খাতের এ দুরবস্থার কারণে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

ইতোপূর্বে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে প্রচুর অর্থ আয় করতেন কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। তাই সরকারকে এখন ব্যাংকিং উৎস্য থেকে অর্থ আহরণ করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বছরের প্রথম ৬ মাসেই সরকার ব্যাংক থেকে পুরো অর্থ বছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ নিয়ে ফেলেছে। ৬ মাসে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ৪৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।

অর্থ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঋণ গ্রহণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। কারণ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের গতি অর্থ বছরের শেষের দিকেই বেশি থাকে। গত ১০ অর্থ বছরের মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২০১৮-১৯ অর্থ বছরেই সবচেয়ে বেশি। সে বছর সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৫ মাসের জন্য রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা কম।

সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এটা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৩ শতাংশ কম। সরকারের অর্থ আহরণের রাস্তাগুলো যেন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সরকার এখন বিকল্প হিসেবে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে আরও বেশিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের জন্য উদ্যোগী হয়েছেন। এর ফলে সরকারের পক্ষে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে এভাবে সরকারের বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণের প্রবণতায় অর্থনীতিবিদরা উদ্বিগ্ন। তারা মনে করছেন, সরকার যদি এভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করতে থাকে তাহলে আগামীতে ব্যক্তিখাতে ঋণ প্রবাহ আরও কমে যেতে পারে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকার এভাবে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিতে থাকলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। এমনিতেই ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহ অনেকটাই কমে গেছে। গত এক দশক ধরে আমরা একটি বিষয় অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি তা হলো, দেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অনুপাত খুব একটা বাড়ছে না। জিডিপির অনুপাতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ২২-২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে।

ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ব্যাপক মাত্রায় বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের সামনে যে সব চ্যালেঞ্জ আছে তা যদি আমরা কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বাড়ানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ একমাত্র উৎপাদনশীল ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমেই বর্ধিত জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ছাড়া বিনিয়োগ বাড়ানো গেলেই কেবল স্থানীয় চাহিদা পূরণ এবং বিদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্য ও সেবা উৎপাদন সম্ভব।

এ ছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, আয় বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি কঠিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্যও ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন। বিনিয়োগ শুধু বাড়ালেই চলবে না সেই বিনিয়োগ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরি করা। উদ্যোক্তারা যাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সহজেই অর্থায়ন পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ব্রড মানি সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে সরকার চাইলেই ব্যাংকিং সেক্টর থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিতে পারবে। কিন্তু এতে যে অসুবিধা হবে তা হলো, স্থানীয় বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠতে পারে।

এদিকে আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বলেছেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর করতে হলে তার আগে ৬ শতাংশ সুদের আমানত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আমানতের ওপর সুদ হার নির্ধারণ করে দিয়েছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে আমানত সংরক্ষণ করলে সে ক্ষেত্রে সুদের হার হবে সাড়ে ৫ শতাংশ। আর ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে আমানত রাখলে সে ক্ষেত্রে সুদের হার হবে ৬ শতাংশ। কিন্তু এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। কারণ সুদের হার ৬ শতাংশ বা সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করার ফলে সাধারণ মানুষ তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে রাখার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি। এ অবস্থায় ব্যাংকে টাকা রেখে যদি সাড়ে ৫ বা ৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় তাহলে আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই তারা উদ্বৃত্ত অর্থ অন্য কোনো বিকল্প উৎসে সংরক্ষণ করতে চাইতে পারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানতের ৫০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের বিধান করা হয়েছে। আগে এটা ছিল ২৫ শতাংশ।

অনেকেই মনে করতে পারেন এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণের জন্য বাধ্য হবে। ফলে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটে পতিত হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই। কিন্তু এ ধারণা মোটেও ঠিক নয়। কারণ ক’দিন আগে জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপিত হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।

ব্যাংকগুলোর সমস্যা নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে; কিন্তু খেলাপি ঋণ আদায়ের কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো। কিন্তু আইএমএফ বা এ ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা না করে বরং তাদের নানাভাবে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

এককালীন ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ খেলাপি ঋণ ১০ বছরের পুনঃতফসিলিকরণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে পুনঃতফসিলিকরণকৃত ঋণের ওপর সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। অথচ যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছেন তাদের ১২/১৩ শতাংশ সুদ দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আগামীতে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য মারাত্মক তারল্য সংকট অপেক্ষা করছে। এ অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যাবে এ মুহূর্তে সেটাই বড় বিবেচ্য হওয়া উচিত।

এম এ খালেক
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক

 
Electronic Paper