ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইস্তাম্বুলের ‘তহুম’ ও কক্সবাজারের ‘অরুণোদয়’

মো. কামাল হোসেন
🕐 ৮:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৫, ২০২০

দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্রি অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন ফেডারেশনের (ফেমোজা) আমন্ত্রণে সম্প্রতি একটি দলের সঙ্গে তিন দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এই তিনটি দেশের একটি হল তুরস্ক। ভ্রমণসূচি মোতাবেক ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত বুরছাইকোনোমিক জোন দেখতে গিয়েছিলাম ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুলে এক দিন সময় পেয়েছিলাম ঘুরে দেখার। সঙ্গে সহকর্মীরা।

অন্যরা দলবদ্ধভাবে ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। আমি ইস্তাম্বুলে অবস্থিত কনসাল জেনারেল বন্ধু মনিরকে জানালাম কোনো অটিজম স্কুল দেখা যাবে কি না। মনির দাপ্তরিক কাজে আঙ্কারায় অবস্থান করলেও তাঁর অফিস স্টাফ দিয়ে ‘তহুম অটিজম স্কুল’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সকাল ১০টায় সেখানে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে দিলেন। যথাসময়ে হোটেল থেকে রওনা দিয়ে গুগলের কল্যাণে ১০টা ২০ মিনিট নাগাদ তহুম অটিজম স্কুলে পৌঁছে গেলাম।

গেটে পৌঁছাতেই নিরাপত্তাকর্মীরা গেট খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে মনে হলো কোনো সুন্দর অভিজাত বাড়িতে প্রবেশ করছি। স্কুলের সামনে সাজানো গোছানো বাগান। মাঝখানে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আবক্ষ মূর্তি। তুর্কি ভাষায় স্কুলটির নাম ‘তহুম ওতিজা ভাকি’। ২০০৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত ফাউন্ডেশনের অর্থ, সরকারি অনুদান এবং অভিভাবকদের অনুদানে প্রতিষ্ঠানটি চলে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার শিশুদের আরলি ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং সমাজের মূলধারায় মিশ্রণের জন্য বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

তুরস্কে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ, তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেশা বাছাইকরণ, কর্মসংস্থান, স্বতন্ত্র জীবনযাপন, শিশুসহ তরুণদের প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনগুলো পূরণ করা এর অন্যতম লক্ষ্য। সেখানকার একজন কর্মী আমাকে আধো ইংরেজিতে স্কুলের পাঠদানসহ বিভিন্ন কার্যকলাপ বর্ণনা করছিলেন। আমার মনে তখন ভেসে উঠছিল পরম মমতায় গড়া কক্সবাজারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘অরুণোদয়’ স্কুলের কথা। আমাদের অটিজমে আক্রান্ত সন্তানদের কি আমরা এদের মতো করে পরিচর্যা করতে পারব?

এই স্কুলের শ্রেণিকক্ষগুলোর কোনোটিতে চারজন, আবার কোনোটিতে দুজন শিক্ষার্থীর বসার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিজনের পাশে একজন মাঝ বয়সের তরুণী, ভাবছিলাম তাঁরা হয়তো শিশুদের মা। একেবারে মায়ের মতো আগলে ধরেই তাদের শেখাচ্ছেন, পরিচর্যা করছেন। জানলাম, তাঁরা সবাই এ স্কুলের শিক্ষক। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, শিশুদের নানাবিধ আচরণের মধ্যেও তাঁদের ন্যূনতম বিরক্তিবোধ নেই। পরম যত্নে নিজ সন্তানের স্নেহের পরশে নিবিড় পরিচর্যায় মগ্ন তাঁরা। টেবিলের পাশে দেখলাম প্রোগ্রেস চার্ট টাঙানো।

প্রতি ঘণ্টায় শিশুদের আচরণ পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করা হয়। ল্যাপটপ, ইন্টারনেট ব্যবহার করে শিশুদের উপযোগী ছবি, কার্টুন প্রদর্শনের মতো প্রযুক্তির ব্যবহারও হচ্ছে সচেতনভাবে।

জানা গেল, তুরস্কে ৮০ দশমিক ৮১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ৯ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় ১২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী। তাদের মধ্যে মাত্র ৩৬ দশমিক ৪১ শতাংশ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ মিলিয়ন লোক প্রতিবন্ধী, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। ইউনিসেফ প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১০ মিলিয়ন শিশুর মধ্যে ১৪ থেকে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিশু প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত। বিশ্বে প্রতি ১৬০ শিশুর মধ্যে ১টি অটিজমে আক্রান্ত। এসব পরিসংখ্যান চিত্রই বলে দেয়, পৃথিবীজুড়ে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। এসব শিশুর যথাযথ পরিচর্যায় আমরা কতটা প্রস্তুত, বিশ্লেষণের সময় এসেছে।

আমার কর্মস্থল কক্সবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা ২২ দশমিক ৯০ লাখ (২০১১), যার মধ্যে সমাজসেবা বিভাগের হিসাবমতে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ২২ হাজার ৬৯৩। তাদের মধ্যে ১৬ হাজার ৭৩১ জন পুরুষ এবং ৮ হাজার ৯১১ জন নারী। তার মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত পাওয়া গেছে ৩৬৪ জন। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় কমবেশি এ রকম চিত্রই পাওয়া যাবে। জেলাতে অটিজম আক্রান্ত ও বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসা ও শিক্ষাসুবিধা নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকায় জেলা প্রশাসন, কক্সবাজার ‘অরুণোদয়’ নামে এই বিশেষায়িত স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছে।

তিনতলা বিশিষ্ট সুবিশাল ভবন, উন্মুক্ত খেলার মাঠ, বাগানসহ বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি কক্সবাজার জেলায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রথম বিশেষায়িত একটি কেন্দ্র। এখান থেকে প্রতিবন্ধী ও নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশু এবং ছিন্নমূল শিশুদের শিক্ষা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা প্রদান করা হবে। অরুণোদয় থেকে মা ও বাবা এবং পরিচর্যাকারীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন সহায়তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মাধ্যম হিসেবে শিশুদের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্র হিসেবে কাজ করবে অরুণোদয়। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি সংগীত, বিনোদনের ব্যবস্থা ও খেলাধুলার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধিতা-সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা, ২০১৯ অনুযায়ী দেশের প্রতিটি জেলায় ন্যূনতম একটি বিদ্যালয় স্থাপন করার নির্দেশনা রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তবায়িত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের প্রতিষ্ঠান ‘প্রয়াস’ থেকে শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন।

আমার নিজেরও ধারণা লাভের জন্য প্রয়াসের কর্মকাণ্ড, মিরপুরের ‘কল্যাণী’ সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সত্যিই একটি প্রশংসনীয় কাজ করছে। সব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কক্সবাজারের অরুণোদয় হবে কক্সবাজারের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আশ্রয়স্থল।

মো. কামাল হোসেন : কক্সবাজারের ডেপুটি কমিশনার

 
Electronic Paper