ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সিটি নির্বাচনে প্রত্যাশা

ওয়াসিম ফারুক
🕐 ৯:৫৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২০

নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের জন্য অভিনন্দন। সেই সঙ্গে হিন্দু ধর্মাম্বলম্বী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিদ্যাদেবী সরস্বতী পূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা। সবার বিদ্যা জ্ঞান সবই যেন সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার কল্যাণে ব্যয় হয় এমনটিই কাম্য। নির্বাচন কমিশনের নতুন সিডিউল অনুযায়ী আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। প্রায় পুরো ঢাকাজুড়েই নির্বাচনী পোস্টার ও প্রচারপত্রে সয়লাব।

এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো প্রায় সব প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টারই ঝুলছে শহরের অলিগলিতে। যা বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে আমাদের চোখে আসেনি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণার পরিবেশ মোটামুটি শান্ত। কোথাও কোনো অঘটনের খবর আসেনি। আশা করি এ শান্ত ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ প্রতিটি নির্বাচনেই বজায় থাকবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলীয় বিএনপি এখনো ঢাকার অলিগলিতে নির্বাচনী প্রচারণার ব্যস্ততা নিয়ে মাঠে আছে।

দুই ঢাকার সিটি নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অবাধ ও সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখি। বিশ্বাস করছি ঢাকা সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু অধিকাংশ ঢাকাবাসীর মনের কথা, ভোট আর কী হবে হয়তো আগের নির্বাচনগুলোর মতো দিনের ভোট রাতেই সম্পন্ন হবে! অযথা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের চোখ রাঙানি আর ধমক খাওয়ার চেয়ে বাসায় বসে হাঁসের মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি খাওয়াই শ্রেয়!

১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এটাই ছিল ঢাকা সিটির সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন। এরপর আর ঢাকাবাসী প্রাণ খুলে তাদের প্রতিনিধিকে ভোট দিয়ে নির্বাচনের সৌভাগ্য হয়নি। তারপরও যেভাবেই হোক ঢাকা উত্তরের বাসিন্দারা কিছুদিনের জন্য হলেও আনিসুল হকের মতো একজন নগরপিতা পেয়েছিলেন। তার অল্প সময়ের কাজ দীর্ঘদিন স্মরণ করবে ঢাকা উত্তরের বাসিন্দারা।

বুড়িগঙ্গা তুরাগ বালু শীতলক্ষ্যাবেষ্টিত ১৩৪ বর্গমাইলের প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকাকে ২০১১ সালের ১৯ নভেম্বরে জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধনী) বিল, ২০১১ সালের পাসের মাধ্যমে ঢাকা সিটি করপোরেশন বিলুপ্ত করা হয়। এর ফলে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নামে স্বতন্ত্র দুটি করপোরেশন গঠন করা হয়।

ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করার মূল উদ্দেশ্যই ছিল উন্নত নাগরিক সেবাপ্রদান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা নগরবাসী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে উন্নত নাগরিকসেবা তো দূরের কথা ন্যূনতম সেবাটুকুও পেয়েছি কি-না সেটাই বড় প্রশ্ন।

যুগ যুগ ধরে ঢাকাবাসী প্রচলিত প্রবাদ রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়েই ঢাকায় আছি। আজ এ বৃহত্তম ঢাকার নগরীতে কি শুধু মশা আর মাছিই মূল সমস্যা? মোটেও নয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা নগরীর আরও নতুন নতুন সমস্যা গজিয়েছে। বর্তমানে মশা মাছির সঙ্গে ঢাকার যে মূল সমস্যা তা হলো যানজট আর মাদক। জানি না যানজট ও মাদকের দায় কতটুকু জনপ্রতিনিধিদের ওপর বর্তায়? তবে মাদকের দায় প্রায় অনেকটাই জনপ্রতিনিধিদের।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদকের স্পট রয়েছে তার বেশিরভাগ পরিচালনার দায়িত্বে আছে অসাধু রাজনৈতিক নেতাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ নিয়ে আমাদের জাতীয় সংসদেও বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা হতে দেখেছি, মাঝে মাঝে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি মাদকসহ গ্রেফতার হতেও দেখেছি। এবারের দুই ঢাকা সিটি নির্বাচনের বেশ কিছু কাউন্সিলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও ব্যবসার অভিযোগ আছে স্থানীয় মানুষের। জানি না তারপরও তারা কীভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন!

মাছি যাই হোক কথিত আছে- মশার জন্য ইতিহাসে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে দুজনকে। এক ছিল নমরুদ আর বর্তমান সময়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। গত বর্ষা মৌসুমে ঢাকার মূল আতঙ্কই ছিল এডিস মশা। এডিশ মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিতে হয়েছে অনেক মানুষকেই। যদিও পরবর্তীকালে ডেঙ্গু মরণব্যাধি হয়ে সারা দেশেই আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। ডেঙ্গুর জন্য শুধু সাঈদ খোকন দায়ী নন। সরকারের সংশ্লিষ্ট কেউই দায় এড়াতে পারবে না। এমনকি আমরা নগরবাসীও না। তবে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ অভিযোগের কমতি নেই।

ঢাকা আজ বিশে^র অন্যতম বিষাক্ত নগরীর একটি। ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে আজ সুস্থভাবে বেঁচে আছি কল্পনাতীত। ঢাকা নগরীর যানজটের কথা নিয়ে নতুন করে বলার কিছুই নেই। এখানে বাসের গতি ঘণ্টায় ৬ কিলোমিটার আর মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটার! আগেই বলেছি ঢাকা নগরী সমস্যার অন্ত নেই। তার মূল কারণ ঢাকা কেউ সিঙ্গাপুর কেউ কুয়ালালামপুর কেউবা প্যারিস বানানোর স্বপ্নে বিভোর ছিলেন বা আছেন অথচ কেউই ঢাকাকে ঢাকা বানাতে চাননি।

বলছিলাম অনুষ্ঠিতব্য দুই ঢাকা সিটি নির্বাচনের কথা। এ নির্বাচনে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোই অংশ নিয়ে তাদের প্রার্থী দিয়েছে। দক্ষিণে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১০ আসনের দুবারের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে। আর বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আছেন অবিভক্ত ঢাকার সাবেক প্রয়াত মেয়র ও সাবেক মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকার পুত্র ইশরাক হোসেনকে। ইশরাক বয়সে তরুণ, রাজনীতিতে একেবারেই নতুন।

যেহেতু শিক্ষিত ও রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা আছে। পিতা সাদেক হোসেন খোকাই তার পরিচিতির মূল। পৃথিবীতে কেউই অভিজ্ঞতা নিয়ে জন্ম নেয় না। সবাইকেই কোনো না কোনোভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ইশরাক ঢাকা দক্ষিণের ভোটের মাঠ গরম রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস দুবার ঢাকা-১০-এর সংসদ সদস্য। একই সঙ্গে একজন আইনজীবী এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও পরিচিতি দুটোই মোটামুটি ভালো।

রাজনীতিতে পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে শেখ পরিবারের সুনাম ধরে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনকে সবাই রাজনীতিতে পোস্টার বয় হিসেবেই চেনেন। হাজী মিলনের রাজনীতি ও জনকল্যাণে তেমন অবদান না থাকলেও তার পোস্টারে ছেয়ে যায় পুরো ঢাকার শহর।

ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম। বিএনপি থেকে মাঠে নেমেছেন তাবিথ আউয়াল। আতিক সাহেব সজ্জন হিসেবে পরিচিত। খ্যাতনামা এ ব্যবসায়ী বিজিএমইএর সভাপতিও ছিলেন। রাজনীতিতে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও বর্তমানে মেয়র হয়ে মোটামুটি রাজনীতিতে ভালই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। প্রায়ত মেয়র আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজের দিক ভালোই মনোনিবেশ করেছিলেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা আছে।

হকারদের দখলে ফুটপাত আর ট্রাক মালিকদের দখলে তেজগাঁয়ের সাতরাস্তায় ট্রাকস্ট্যান্ড আগের মতোই আছে। এডিস মশার উৎপাত তার এলাকায়ও কম হয়নি। সম্ভ্রান্তদের এলাকায় ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই মরেছেন। তাবিথ আউয়াল বিএনপি নেতা সাবেক এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে। গত ঢাকা সিটি নির্বাচনে মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হলে বিএনপির ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থী হন তাবিথ আউয়াল। গত নির্বাচনে অংশ নিয়ে এরপর বিএনপির রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে মোটামুটিভাবে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। নির্বাচনী প্রচারণায় শক্তভাবেই মাঠে আছেন তাবিথ আউয়াল। আর নতুন রাজনীতিতে পা রেখেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কামরুল ইসলাম জাতীয় পার্টির মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন।

রাস্তাঘাটে তার কিছু পোস্টার দেখা গেলেও প্রচারণার মাঠে তেমন দেখা মিলছে না তার। তবে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অনেকের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর ব্যবসা, জমিদখল, চাঁদাবাজিসহ অনেক অভিযোগই আছে। আবার অনেক এলাকায় দুই দলেরই আছে একাধিক প্রার্থী। তবে একাধিক অর্থাৎ বিদ্রোহী হিসেবে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের বেশি।

প্রার্থীরা সবাই ভোটারদের দরজার কড়া নেড়ে সালাম দিয়ে ভোট চেয়ে যাচ্ছেন। এখন শুধু দেখার বিষয় পহেলা ফেব্রুয়ারি সরকার, নির্বাচন কমিশন ও তার প্রশাসন আমাদের কেমন ঢাকা সিটি নির্বাচন উপহার দেয়? জনগণ কি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন নাকি অতীতের মতো ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নাকাল হয়ে ফিরে আসতে হবে। নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাব খুবই নেতিবাচক।

এমন ধারণা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মোটেও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আমরা চাইব নির্বাচন কমিশন আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করে নিজের দায়িত্বশীলতার প্রমাণ রেখে অতীতের বদনাম কিছুটা হলেও ঘোচানোর চেষ্টা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে যে আশার স্বপ্ন দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়নের জন্য সহনশীল মনোভাব নিয়ে তার দলের কর্মী ও নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই সঠিক দায়িত্ব পালন করে একটি অবাধ সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকাবাসীকে তাদের পছন্দের প্রতিনিধি সহায়তা করবেন। সেই সঙ্গে অতীতের নির্বাচনী কলঙ্ক মুছে জাতিকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক নির্বাচন ধারা উপহার দেবেন বলেই জাতির প্রত্যাশা।

ওয়াসিম ফারুক : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper