ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রত্যাবর্তন, পূর্ণতা ও প্রেরণা

সাধন সরকার
🕐 ৮:৫১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২০

মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর কাক্সিক্ষত বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়ে যায়! কেননা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, যার হাত ধরেই আসে স্বাধীনতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তখনো পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দি। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরের একপ্রান্তে একজন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, মহাকাব্যিক নেতা, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রহসনের বিচারে চার দেয়ালে কারাবন্দি হয়ে লড়ে যাচ্ছেন, অপর প্রান্তে সাত কোটিরও বেশি বাঙালি প্রিয় নেতার মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। অবশেষে দেশি-বিদেশি শক্তির চাপে বাঙালির প্রিয় নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। প্রায় ৯ মাস পর আকস্মিকভাবে মুক্তি পেয়ে জাতির পিতা লন্ডন ও দিল্লি হয়ে স্বাধীন দেশে পা রাখেন। মহানায়কের প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে জাতির পিতা যখন বন্দি হন তখন দু’পক্ষের যুদ্ধ চলমান।

তারও আগে ’৪৭-এর দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অগ্রভাগে। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে মুক্তির মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত করেছিলেন। জাতির পিতা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তারও আগে ১৯৩৯ সালে। তখন তিনি ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের একজন সাধারণ কর্মী। ১৯৪৭ সালে জাতির পিতা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলা ভাষা দাবির পক্ষে স্বাক্ষর গ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মসলিসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দান করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল) পালিত হয়। এই হরতাল থেকে জাতির পিতাসহ অনেককে গ্রেফতার করা হয়। পরে আবার ১৯৪৯ সালে ভুখা মিছিলের আয়োজন থেকে বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃত্বস্থানীয় অনেককে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের শেষ পর্যায়েও জাতির পিতা জেলে ছিলেন। জেলে থাকলেও ভাষা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জাতির পিতা পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরের বছর গণপরিষদের সদস্য হন। জাতির পিতা ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’খ্যাত ছয় দফা ঘোষণা করেন ১৯৬৬ সালে। ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলন সুদৃঢ় হয় এবং শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে ফুঁসে ওঠে। ছয় দফা প্রতিহত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করলেও শেষ পর্যন্ত ছয় দফাই বাঙালি জাতিকে মুক্তির পথ দেখায়। একের পর মামলা ও জাতির পিতাকে কারাগারে পাঠিয়েও বাঙালির মুক্তির আন্দোলনকে দমানো যায়নি। ১৯৬৮ সালে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য’ নামে বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের ওপর ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দেওয়া হয়। মিথ্যা মামলা দিয়েও জাতির পিতা ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯, জাতির পিতা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ পরিবর্তে রাখেন ‘বাংলাদেশ’। ’৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে এনে জাতির পিতা হয়ে ওঠেন বাঙালির মুখপাত্র, ভাগ্য নিয়ন্তা। ’৭০ এর নির্বাচন ছিল বাঙালি তথা বঙ্গবন্ধুর অগ্নিপরীক্ষা, সেখানেও তিনি সফলভাবে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল মেনে জাতির পিতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। ফলশ্রুতিতে চূড়ান্ত মুক্তির আন্দোলন যেন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ৭ মার্চ ১৯৭১, জাতির পিতা রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিকামী মানুষের সস্মুখে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিলেন। ১৮ মিনিটের এই রক্তদোলানো ভাষণই মুক্তিপাগল জনসাধারণকে জাগিয়ে তোলে। জাতির পিতা ঘোষণা করেন- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর গণহত্যায় মেতে ওঠে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ফলশ্রুতিতে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। জন্ম হয় বাংলাদেশের। জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের জেলে বন্দি। জেলে বন্দি থাকলেও জাতির পিতাকে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার ও জনগণ সর্বদা মনে রেখেছে, তার মুক্তির জন্য পথপানে চেয়ে থেকে তার নির্দেশ মতো এগিয়ে গেছে। বিজয়ের ২২ দিন পর ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার প্রত্যাবর্তনে বাঙালির স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়। জাতির পিতার নীতি, আদর্শ ও স্বপ্ন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথে অনন্ত প্রেরণা। জাতির পিতার বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে তার আদর্শ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

সাধন সরকার : পরিবেশ কর্মী
সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
[email protected]

 
Electronic Paper