পাঠকের মতামত
দেশ আমার দোষ আমার
নাজমুস সাবাহ কুবরা
🕐 ৮:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২০
বাংলাদেশ আজ হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্বাধীনতার ৪৮ বছর উদযাপন করছে। এই স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালি জাতিকে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা অন্য কোনো জাতিকে করতে হয়নি। বাঙালি জাতির ইতিহাসটাও সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো আমাদের রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।
১৯৭১ সালের আগের সময়ে ফিরে তাকালে আমরা বাঙালি জাতির নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ দেখতে পাই। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সংগ্রাম শুরু হয়, যা পরবর্তী সময়ে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের রূপ নেয়। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন হয় মূলত বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ থেকে। বাঙালি নিজ সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি কতটা সচেতন তা রফিক, বরকত, শফিক তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে। যা সত্যিই আমাদের জন্য গর্ব ও শিক্ষা অর্জনের বিষয়।
’৫২-র ভাষা আন্দোলনের সব শহীদ থেকে শুরু করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ সবই বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা ও দেশপ্রেমেরই রূপ। কিন্তু এত কিছুর পরও আজ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে একটি বড় প্রশ্ন রয়ে যায়। আর সেটা হলো, এই বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমরা কি আদৌ সেই দেশপ্রেম, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতাবোধ ধরে রাখতে পেরেছি? নাকি ধসে পরা জাতির মতো অন্যের ভাষা ও সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে মত্ত আমরা। আজ পুরো দেশজুড়েই চলছে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা ও অবমাননা।
বাঙালি উৎসবমুখর। সারা বছর নানা পূজা, পার্বণে মুখর থাকে আর এসব আয়োজনে আজকাল দেখা যায় বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। দেশীয় স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র; কিন্তু আজকাল সেখানেই ভূলুণ্ঠিত দেশীয় সংস্কৃতি। এসব প্রতিষ্ঠানে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় সেখানেই দেখা যায় ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগ ডে পালন করা হয় অনেক জাঁকজমকভাবে, যা থাকে নাচে গানে ভরপুর। আর এসব এর বেশিরভাগ জুড়ে ভারতীয় বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সব গান।
যেখানে কোন দেশীয় গান বাজানোর কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জাতির কর্ণধার, পরবর্তী সময়ে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব এদেরই ওপর, তাই তাদের বেশি সচেতন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ তারাই উদাসীন, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
আমাদের দেশ সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, আমাদের রয়েছে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, পালাগান, কবিতা, ছড়া, নাটক, গল্প ও আরও অনেক কিছু। তাই আমার মতে ভিনদেশি সংস্কৃতির কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। জাতীয় দিবস যেমন- স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি দিবসগুলো অনেক জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়, যার জন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করতে হয়। কিন্তু দেখা যায় সকালের দেশপ্রেম বিকেলে কোনো বিদেশি সংস্কৃতির আদলে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয়।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজ ভাষা তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানের। যা আমাদের জন্য নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির অনুপ্রেরণা। অথচ আজকাল অর্থ ব্যয় হয় ঠিকই; কিন্তু সেই চেতনাবোধের উদয় নেই আমাদের মাঝে। তাই এসব জাতীয় দিবস উদযাপন এক পর্যায়ের দেশপ্রেমের নামে প্রহসনে পরিণত হয়।
এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমরা আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ভুলে বিপথগামী হয়ে পড়ব আর এ দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। এ দায় আপনার, আমার, আমাদের সবার। তাই আমাদের সবার সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। দেশ আমাদের তাই সচেতনতার দায়িত্বও আমাদের।
পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সুস্থ, সুন্দর সাংস্কৃতিক উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। এখনি তার মোক্ষম সময়। যে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের শুরুই হয়েছে ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সচেতনতা থেকে, সে জাতির মহান দায়িত্ব সেই ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা ও তার চর্চা করা।
নাজমুস সাবাহ কুবরা : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]