ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সামাজিক অবক্ষয়েই পারিবারিক সহিংসতা

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:৩৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২০

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ নিয়েই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে যখন ঘুঘ, দুর্নীতি, লুটপাট ব্যাপকতা লাভ করে, তখন মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে সামাজিক অনাচার, হিংস্রতা, সহিংসতার আগ্রাসন বাড়তেই থাকে। মূলত একটি ভোগবাদী রাষ্ট্র কাঠামোয় গুটিকতক মানুষের লোভ লালসা, বিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধ হওয়ার নীরব প্রতিযোগিতা চলে। মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ে। ধনীর চেয়ে গরিবের সংখ্যাও বাড়ে পাল্লা দিয়ে।

যদিও আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনরা বলে থাকে, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছে, নিকট ভবিষ্যতে দেশ থেকে দারিদ্র্যকে চিরবিদায় দেওয়া হবে। হয়তো এ দাবি করার পেছনে দেশের উন্নয়ন, হাটবাজার, নগরায়ণের ব্যাপ্তি, শহরকেন্দ্রিক জৌলসে ভরা বিপণী বিতানের ছড়াছড়িকে ইঙ্গিত করা হয়।

বাস্তবে কিন্তু যে হারে নগর, মহানগর কিংবা মফস্বল শহরগুলোয় বিপণি বিতান স্থাপিত হয়েছে, সে হারে ক্রেতার সক্ষমতা বিশেষ কোনো উৎসব ব্যতীত চোখে পড়ে না। অর্থাৎ দেশের স্বল্পসংখ্যক মানুষের আয় উন্নতি বাড়লেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থিক দৈন্যতা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে, যা প্রমাণের জন্য শহরমুখী প্রতিটি মানুষের চোখে দেখা অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।

যেমন- দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটলেই দোকানিদের হাঁকডাক কানে আসে। অনেকেই বিনয়ের সঙ্গেই ডাকাডাকি করেন। বিশেষ কাজে মাঝে মধ্যেই ঢাকায় অনেকেই আসা-যাওয়া করেন, আমাকেও মাঝে মধ্যে ঢাকা যেতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমি ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানের রমনা ভবনের সামন দিয়ে হাঁটছিলাম। এক দোকানির ডাক শুনে দাঁড়ানো মাত্রই বললেন, সকাল থেকে কোনো বেচাবিক্রি হয়নি। ওনার আগ্রহ দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যবসা কেমন চলছে? জবাবে বললেন, ভাই ব্যবসা একেবারেই মন্দা। আমারও মনে হলো, বাস্তবে ব্যবসায়ীদের মন্দ সময় চলছে। আর এটাই বাস্তবতা।

কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশে কিছু মানুষ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধায় অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ হবেন। যার উপার্জিত অর্থে ব্যবসার প্রসার ঘটাবেন। জৌলুসে ভরা বিপণি বিতানে থরে থরে পসরা নিয়ে দোকানিরা অপেক্ষা করবেন; কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে আসলে, ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। যে কারণেই এখন ব্যবসায় মন্দা ভাব বিরাজ করছে। অর্থাৎ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্থ গুটিকতক মানুষের মাঝে কেন্দ্রিভূত হবে। ফলে একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

যারা বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে নানা খাতে বিনিয়োগ করবে। ফলে দেশের ছোট, মাঝারি ধরনের শিল্প ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বহুজাতিক কোম্পানির গর্ভেই বিলীন হবে। এভাবে কর্মসংস্থান হারানোর সংখ্যাও বাড়বে, বেকারত্ব বাড়বে এবং মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ার কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন মানও নিম্নমুখী হবে। স্মরণে রাখতে হবে, দুর্নীতি, লুটপাট এবং ঘুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে, তারই গর্ভে জন্ম নেবে হতাশা, অনৈতিকতা, সহিংসতা ও নির্মমতার।
মানুষের বিত্ত-বৈভবে সমৃদ্ধ হওয়ার কোনো সীমারেখা নেই। যার যত অর্থ হবে, সে ততই আরও বিত্তশালী হওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে কপর্দক শূন্য হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে অনেকেই কলাগাছ হচ্ছেন। যাদের কেই কেউ আরও বিত্তশালী হতে নিকৃষ্ট ব্যবসা মাদকের পথেও হাঁটতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এভাবেই দেশটিতে মাদকের বীভৎসতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।

অনেকেই হতাশার চোরাবালিতে মাদকাসক্ত হচ্ছে, আবার কেউ কেউ বিত্তশালী পরিবারের অঢেল অর্থের কারণেও বিপথগামী হচ্ছে। পরিবারের কর্তা শুধুই ছুটছেন অনৈতিক অর্থের পাহাড় গড়তে, আর অর্থবিত্তের কারণে অজান্তেই নিজের সম্পদ সন্তানটি মাদকাসক্ত হয়ে পরিবারের বোঝা হচ্ছে। এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। ফলে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে খুন হচ্ছেন প্রিয় বাবা, মা, ভাই-বোন। কারণ একজন মাদকাসক্ত ছেলে কিংবা মেয়ের কাছে মাদকের অর্থের জোগানই মুখ্য।

আবার অঢেল অর্থের কারণে বিকৃত যৌন পাপাচারের সম্ভাবনাও বাড়ে। যা নিয়ে পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আবার কেউ কেউ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। অর্থাৎ অসুস্থ পরিবার ও সমাজে সন্দেহ, অবিশ্বাস বাড়তেই থাকে। ফলে মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ, মায়া মমতার বদলে হিংস্রতার পথই প্রশস্ত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে পারিবারিক সহিংসতার বলি হচ্ছেন অনেকেই। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন, মায়ের হাতে ভাই-বোন খুন, এমনকি ছেলের হাতে বাবা-মাকে নির্দয়ভাবে খুন হতে হচ্ছে। এ অবস্থা দেশের নিভৃত পল্লী থেকে নগর মহানগর পর্যন্ত দিনে দিনে বিস্তৃত হচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে পারিবারিক সহিংসতা কিংবা সামাজিক সহিংসতার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরাও মনে করি, সুস্থ ধারার সামাজিক বন্ধনকে শক্তিশালী করতে না পারলে খুনখারাবির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে না।

এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সিলিং করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকদের আন্তরিক হয়ে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পদ সন্তানদের মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। যেন কোনো সন্তান বাবা-মায়ের অবহেলা কিংবা উদাসীনতায় মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আগেই বলেছি, দেশের অভ্যন্তরে গুটিকতক উচ্চাভিলাষী অর্থখোররা আরও বিত্তশালী হতে মাদকের মতো অধপতিত ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলে মাদকের চালান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আনা নেওয়া করছে।

কিন্তু তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, যা আমাদের বোধগম্যের বাইরে। অথচ দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে একের পর এক সফলতার দৃষ্টান্ত যেখানে প্রতীয়মান হচ্ছে, সেখানে মাদক সম্রাটরা কেন ধরা পড়ছে না? হয়তো এ বিষয়ে উপযুক্ত জবাব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই ভালো বলতে পারবেন। তবে, আমরা খালি চোখে যা দেখি তা হলো, ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে যারা দেশ শাসন করেন, তারা শ্রেণিস্বার্থ রক্ষাকেই বেশি প্রাধান্য দেন। ফলে চুনোপুটিরা ধরা পড়লেও অতি ক্ষমতাধর বিত্তশালীরা বরাবরই দৃষ্টির বাইরেই থেকে যান।

আমাদের বিশ্বাস, দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আন্তরিক হলে এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে বাধা না পেলে মাদক সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা কঠিন কোনো কাজ হবে না। যেখানে জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শক্তিশালী জঙ্গি বাহিনীকে পরাস্ত করতে এ দেশে এলিট ফোর্স র‌্যাব, পুলিশ বাহিনী ও সহযোগী সংস্থাগুলো প্রতিনিয়তই সফল অভিযান পরিচালনা করছেন, সেখানে মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা কেন সম্ভব হয় না? যা জাতির প্রতিটি নাগরিকের একমাত্র জিজ্ঞাসা।

এ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বাস্তব সত্যকে উপলব্ধিতে নিয়ে মন্তব্য করেছেন, সামাজিক অবক্ষয়, সামাজিক অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্ক, সহনশীলতার অভাব, দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার প্রবণতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, আত্মকেন্দ্রিকতা, অসচ্ছলতা, বেকারত্ব ও পরিবারের মধ্যে সহিষ্ণুতার অভাবের কারণে সামাজিক ও পারিবারিক সহিংসতা বেড়েই চলছে।

এ প্রসঙ্গে মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামাল বলেন, মাদকের কারণে ‘হেলুসিনুশেনের’ কারণে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ বাড়ছে, যা মানসিক রোগের উপসর্গ তৈরি করছে। আবার মাদকের প্রভাবে সন্তানের সঙ্গে পরিবারের সম্পর্কও নষ্ট হচ্ছে। ফলে সমাজ এমন অস্থির পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক চিন্তার জায়গা লোপ পাওয়ায় সহিংসতার বলি হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্ক। অর্থাৎ ঘুরে ফিরেই মাদকের বিরূপ প্রভাবই যে সুস্থ সমাজ গঠনের পথে বড় অন্তরায়, তাই প্রমাণিত হচ্ছে। অর্থাৎ মাদকের আগ্রাসনে নির্মমতা, সহিংসতা, হিংস্রতা দিনে দিনে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এসব কারণে তরুণ-তরুণীরা পর্নোগ্রাফির দিকে ঝুঁকছে। যার ফলে সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা বাড়ছে।

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ নিয়েই যে রাষ্ট্রে আমাদের বসবাস, সে রাষ্ট্রকে বাসোপযোগী করতে হলে মাদকের আগ্রাসন যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে। আর মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করতে না পারলে ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক বন্ধনের অভাবে পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় সহিংসতাকে রোধ করা সম্ভব হবে না।

এ জন্য সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাষ্ট্র যন্ত্রগুলোকে সততার সঙ্গে পেশাদারিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সততার সঙ্গে আরও আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এবং সামাজিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করলে মাদকের আগ্রাসন অনেকাংশেই রোধ করা সম্ভব হবে। আর তা করতে না পারলে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতা মহামারিতে রূপ নেবে, যা নির্দ্বিধাই বলা যায়।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]

 
Electronic Paper