পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-দীক্ষা
তানভীর আহমেদ রাসেল
🕐 ৯:৫৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৬, ২০২০
এইচএসসি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর হাজারো শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ শিক্ষার দুয়ারে প্রবেশ করতে ও অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে অংশ নেয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে। রুদ্ধতার এমন প্রতিযোগিতায় সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভাগ্যে জোটে সোনার হরিণের ন্যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিট।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীর কাছে সোনার হরিণ এই ভেবেই যে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন একটি জায়গা যেখানে রয়েছে জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত অবকাশ ও স্বাধীন চিন্তা বিকাশের অফুরন্ত সুযোগ। রয়েছে একদল অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী যাদের পাঠদান ও আন্তরিকতায় সমৃদ্ধ হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বিকশিত হবে মনন ও মননশীলতা। আসলে কি তা হচ্ছে?
যুক্তিবাদী মানুষ তৈরি ও গবেষণাকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পরিবর্তে নানান অসঙ্গতি, অসততা, আধিপত্য বিস্তার ও ক্লাসরুমগুলো সংকুচিত করার মাধ্যমে ক্রমেই শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ফলে ক্লাসের প্রতিও অনীহা বেড়েই চলছে শিক্ষার্থীদের।
একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ইতিহাস ও প্রাণরসায়ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের প্রায় শখানেক শিক্ষার্থীর ওপর জরিপের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
এর নেপথ্যে থাকা প্রধান কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের ক্লাসের প্রতি অনীহা, ক্লাস নিলেও অনেকটা দায় সারার মতো মানসিকতা উচ্চ শিক্ষার অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। আবার নির্দিষ্ট কোর্সের জন্য নির্ধারিত বই ফলো না করে ইন্টারনেটের কয়েক পৃষ্ঠার শিট কিংবা স্লাইডের গৎবাঁধা মুখস্থ লেখাগুলো ঝড়ের বেগে আট থেকে দশ লেকচারের পড়া শেষ হয়ে যাচ্ছে ১-২ ঘণ্টার ক্লাসে যা কিনা উচ্চ শিক্ষার প্রকৃত অর্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিক্ষার্থীবান্ধব আচরণের পরিবর্তে রক্তচক্ষু প্রদর্শন ক্রমেই দূরত্ব তৈরি করছে গুরু ও শিষ্যের মধ্যে যা শিক্ষার জন্য অশনিসংকেত।
এছাড়াও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য ও ভিন্ন মতের শিক্ষার্থীদের প্রতি রূঢ় আচরণ ক্রমেই নষ্ট করছে জ্ঞান চর্চার তীর্থস্থানগুলোকে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নানান সময়ে নানান ধরনের আন্দোলনের মুখে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা-কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলো বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায়, প্রতিটি অক্ষরের মাঝে চাপা পড়ে থাকে মাসের পর মাস। ছয় মাসের সেমিস্টার শেষ হতে লেগে যায় নয় কিংবা দশ মাসও। ফলে সেশনজটের মতো বিষফোঁড় নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থীকে।
যার ফলে চার বছরের অনার্স শেষ করতে লেগে যায় ছয় বছর কিংবা তারও বেশি সময়। সেই সঙ্গে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপর ভর করা, মা-বাবা, ভাই-বোন, কিংবা প্রিয়জনের অপেক্ষা এবং অবহেলার মাত্রাও বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। সমাবর্তন বক্তব্যে তিনি বলেন, অনেক ভিসি ও শিক্ষকবৃন্দ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ পদবি পেয়ে নিজেদের মৌলিক পরিচয়ই ভুলে গেছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্সে অনেক শিক্ষকদের খামখেয়ালি মনোভাব থাকলেও এসব বাণিজ্যিক কোর্সে খুব সিরিয়াস কর্মতৎপরতা দেখা যায়, যা কিনা সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরির অন্যতম প্রতিবন্ধক। উদ্বেগ প্রকাশ করেন শিক্ষাঙ্গনে অস্থির পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চার আঁতুড়ঘর। জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান তৈরির কারখানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সংজ্ঞার যথার্থ ও বাস্তবধর্মী রূপ দিতে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, শিক্ষকদের ইতিবাচক ও ছাত্রবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। তবেই পূর্ণতা পাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত সত্তা। তৈরি হবে সোনার মানুষ। আলোকিত হবে প্রিয় স্বদেশ।
তানভীর আহমেদ রাসেল : শিক্ষার্থী
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]