ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ জরুরি

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৮:৪৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২০

নারীর প্রতি সহিংসতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকেই দায়ী করেন অনেকে। এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে হলে রাষ্ট্র যন্ত্রগুলোকে পেশাদারিত্ব নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ব্র্যাক অ্যাকশন এইড, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা অনেক বেড়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ফোরাম ও বিভিন্ন সংস্থার জরিপ ও গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে আগের বছরের তুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। রাজধানীতে নারী ও মেয়ে শিশুর প্রতি সহিংসতা-বিষয়ক ‘কার শহর’ শীর্ষক অ্যাকশন এইড পরিচালিত এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের শহর এলাকায় ৫৪ শতাংশের বেশি নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে সবুজের অভিযান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মাহমুদা বলেন, নারী সহিংসতা সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা গেছে, ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। মূলত দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালানোর মতো আর্থিক সঙ্গতির অভাবের কারণে অনেক সময়ই মামলার বাদী মামলা মোকাবেলা করতে পারে না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আবার নির্যাতনের পরও অনেক নারীই মামলার ঝামেলা এড়ানোর জন্য মামলা করেন না। আবার দেশের আইনি কাঠামোয় নির্যাতিতকেই প্রমাণ করতে হয় যে, সে নির্যাতনের শিকার। প্রকাশ্য আদালতে মামলা পরিচালনা হওয়ায় অনেকেই লাজ লজ্জার কারণে আদালতকে এড়িয়ে চলতে চান। অর্থাৎ যখন নির্যাতিতকেই সাক্ষ্য প্রমাণে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করতে হয়, তখন ভাবাটাই স্বাভাবিক এ প্রক্রিয়া জটিল। এরপরও কেউ আইনের আশ্রয় নিলে অনেক ক্ষেত্রেই তদন্তকারী কর্মকর্তাদের খুশি (?) করতে না পারলে তদন্ত প্রতিবেদন সঠিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও পক্ষপাতিত্বের নানা অভিযোগও অনেক পুরনো। সবমিলে আমাদের দেশে বিশেষ করে যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে সহসাই ন্যায়বিচার পাওয়া অনেকটাই কঠিন। কারণ, মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া বিচারক কাউকে সাজা দিতে পারেন না। কিন্তু আমাদের সমাজে সাক্ষীও অনেক সময় প্রভাবিত হয়ে থাকেন। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া অনেকের ভাগ্যেই জোটে না। এরপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের দেখাও মেলে।

দুই বছর আগের ঘটনা। ২৫ আগস্ট নিয়োগ পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ আসার পথে জাকিয়া সুলতানা রুপা নামের জীবন সংগ্রামী এক নারীকে বাসের মধ্যে একা পেয়ে বাসের চালক ও অন্যরা তাকে গণর্ধষণের পর খুন করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে রেখে যায়। পুলিশ বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ময়নাতদন্ত শেষে টাঙ্গাইলের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করে। পরে হতভাগী রুপার পরিচয় শনাক্ত হলে লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় বাসের চালকসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতে মামলাটি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় এবং রায়ে ৪ জনকে ফাঁসি ও এক জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ে ছোঁয়া পরিবহনের বাসটিকে নিহত পরিবারের নামে মালিকানা পরিবর্তন করে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করার জন্য মধুপুর থানা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত। এভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হলে নারী সহিংসতার মাত্রা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে আমরা মনে করি। আমরা আশাবাদি, দৃষ্টান্তমূলক এ শাস্তি উচ্চ আদালতেও যেন বহাল থাকে এবং যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির রায় দিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দেওয়া নিম্ন আদালতের রায় যেন কার্যকর হয়। কারণ এ ধরনের মামলায় যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির রায় হয়েছে, তা উচ্চ আদালতে বহাল থাকলে এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যাবে, অপরাধী যেই হোক শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

মূলত আমাদের দেশটিতে মাদক, অশ্লীলতা, বেলেল্লাপনার মাত্রা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যার বিরূপ প্রভাবে তরুণ সম্প্রদায় ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে মাদকের টাকার জন্য খুন, ছিনতাই থেকে শুরু করে এমন কোনো হীন কাজ নেই, যা করতে তারা সামান্য দ্বিধা করে। সংগত কারণেই প্রতিদিন খুন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, সর্বোপরি ধর্ষণ বেড়েই চলছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকেও প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি আসে ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের সুবাদে যৌন ছবির ছড়াছড়িতে যুব সম্প্রদায় দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে নৈতিক মূল্যবোধ। ফলে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে যুব সম্প্রদায় এখন রুচিহীন যৌনতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। ফলে ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ড বর্তমানে ক্যান্সারের মতোই সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ অবস্থা রোধ করা সম্ভব না হলে সামাজিক অবক্ষয়, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অপমৃত্যু ঘটবে। এ জন্য সামাজিক আন্দোলনকে যেমন জোরদার করা জরুরি, তেমনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদারিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হবে মাদক নামক ইয়াবার আস্তানাগুলোকে। পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে খোদ রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে নিভৃত পল্লীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ইয়াবার আগ্রাসন মহামারিতে রূপ নিয়েছে। তরুণ-তরুণীরা ইয়াবার ছোবলে এখন দিশেহারা। মাঝে মধ্যে মাদকের চালান ধরা পড়ে সত্য; কিন্তু চুনোপুটিরা ছাড়া রাঘববোয়ালরা থেকে যায় পর্দার আড়ালে।

জনশ্রুতি আছে, অনেক সময়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে সমাজ বিধ্বংসী ন্যক্কারজনক কাজে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে মদদ দিচ্ছে। তাহলে এর কি কোনো শেষ হবে না? এর সঠিক জবাব পাওয়াও ভার! কারণ, যখন প্রভাবশালী ক্ষমতাধর রাঘববোয়ালরা এ ধরনের অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন, তখন তাদের আইনের আওতায় আনাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তা না হলে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা পড়ে না কেন?

অতিসম্প্রতি রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে রাস্তার পাশ থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। ইতিমধ্যে ধর্ষক মজনু র‌্যাবের হাতে আটকও হয়েছে। সচিত্র প্রতিবেদন এবং তদন্তকারী সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, সিরিয়াল রেপিস্ট মজনু মাদকাসক্ত ও কুরুচিপূর্ণ একজন মাতাল।

যখন একজন মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে যায়, তখন তার মধ্যে বিবেক বিবেচনা কোনো কিছুরই মূল্য থাকে না। এ ভাবেই দেশটি যেন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে! আমরা চাই, এ ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের দ্রুত বিচার ট্রাইবু্যুনালে বিচার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। একমাত্র আইনের শাসনকে নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে এ ধরনের অপরাধকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে।

উপসংহারে শুধু এটুকুই চলতে চাই, সামাজিক অবক্ষয় চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে- এ কথা বলা যায়। ধর্ষণ, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এজন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

আর অপরাধের বিচার স্বল্প সময়ের মধ্যে করতে হবে। অর্থাৎ জনগণ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ব্যতীত নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]

 
Electronic Paper