ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী মণিপুরী সম্প্রদায়

ইসমাইল মাহমুদ
🕐 ৮:৪৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে আদিবাসী মণিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস। মণিপুরীরা ভাষার দিক থেকে দুটি বৃহৎ শাখায় বিভক্ত। দুটি ভাষাবাসী হলো ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ ও ‘মৈতৈ’। এক ও অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উভয় সম্প্রদায়ের। সিলেট বিভাগের চারটি জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় মণিপুরী সম্প্রদায়ের অধিকাংশেরই বাস। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে মণিপুরী সম্প্রদায়ের অবদান অবিস্বরণীয়। এর আগে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলনসহ এ দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে মণিপুরী সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রায় চারশত বছর আগে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, বার্মা থেকে মণিপুরীরা সিলেট অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হতে আগত মণিপুরীদের বড় অংশ আশ্রয় নেন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ-এর ভানুবিলে। বর্তমানে বাংলাদেশে কয়েক হাজার মণিপুরীর বাস।

সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায় দেশ মাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধের ময়দানে সক্রিয় থেকেছে। যুদ্ধে মণিপুরী সম্প্রদায় বিশেষ করে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ সমাজের ত্যাগ তিতিক্ষা ও অবদান জাতি কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করে। দেশের মুক্তি সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করতে হলে মুক্তিযুদ্ধে মণিপুরীদের অবদানের কথা অতি অবশ্যই আসবে।

পাকিস্তান শাসনামলে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায় শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে উপেক্ষা ও বঞ্চনার শিকার হয়। মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের কোনো লোককে চাকরি পেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হতো। ফলে পাক সরকারের প্রতি মণিপুরী সম্প্রদায় বিশেষ করে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের চাপা ক্ষোভ বিরাজমান ছিল। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে পাক হায়েনারা পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা, নির্যাতন শুরু করে। সিলেট বিভাগের মনিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট, সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক ও সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় মণিপুরী পাড়াগুলোতেও শুরু হয় পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন।

মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার কামারছড়া চা বাগানে পাকবাহিনী যুদ্ধের শুরুর দিকেই তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে পাক বাহিনী বাঙ্কার খনন এবং ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য মণিপুরী সম্প্রদায়ের পাড়া থেকে তাদের ধরে এনে কাজ করতে বাধ্য করত। দিনের পর দিন মণিপুরীদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো হতো জোরপূর্বক। এ কাজে ব্যত্যয় ঘটলে বা প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর নেমে আসত অমানসিক নির্যাতনের খড়গ। এরই মধ্যে একাত্তরের ১২ আগস্ট পাক হানাদার বাহিনী আকস্মিকভাবে কমলগঞ্জের ভানুবিল গ্রামে প্রবেশ করে মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ব্রাহ্মণ সার্বভৌম শর্মাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৪ আগস্ট একই এলাকার মণিপুরী নেতা রতন সিংহের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পাক বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা। এ অবস্থায় ভানুবিল গ্রামের অসংখ্য মণিপুরী যুবক যোগ দেন মুক্তি বাহিনীতে।

আলোচ্য প্রতিবেদনে কয়েকজন মণিপুরী যুদ্ধার বীরত্বগাথা উপস্থাপন করা হলো-
নিমাই সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর গ্রামের মণিপুরী মুক্তিযোদ্ধা নিমাই সিংহ। ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের কর্মী নিমাই সিংহ একাত্তরের মার্চ মাসের শেষ দিকে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হাফলং লেয়ার বনে ভারতের সামরিক অফিসার হনুমান সিংহ-এর অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ৪নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে কমলপুর সীমান্তে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। নিমাই সিংহ ধলাই সীমান্ত ঘাঁটি, কুমারঘাট, শ্রীমঙ্গল, আখাউড়া, খোয়াই প্রভৃতি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।

কৃষ্ণকুমার সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভানুবিল গ্রামের রতন সিংহের পুত্র কৃষ্ণ কুমার সিংহ। তার পূর্বপুরুষ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিকামী পরিবারের সন্তান কৃষ্ণ কুমার সিংহকে যুদ্ধের শুরুতে পাক হানাদার বাহিনী কামারছড়া চা বাগান এলাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যম্প সংলগ্ন ঘন জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে বাধ্য করে। পর পর চারদিন অন্যান্য মণিপুরী যুবকদের সঙ্গে তাকে বিনা পারিশ্রমিকে ঘন জঙ্গল পরিষ্কার ও বাঙ্কার খননের কাজ করতে হয়েছে। ১৪ আগস্ট পাক সৈন্যরা কৃষ্ণ কুমার সিংহ’র বাড়িতে ব্যাপক লুটপাট করে। ১৫ আগস্টও পাকবাহিনী কৃষ্ণ কুমার সিংহকে জঙ্গল পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত করে। ওই দিন দুপুরের দিকে কাজ করার এক পর্যায়ে কৃষ্ণ কুমার সিংহ পাহাড়ি পথ ধরে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর মহকুমার ডলুগাঁও গ্রামে চলে যান।

সেখান থেকে তিনি ভারতের জলাইগ্রামের পলটি বাজারে গিয়ে পৌঁছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক রাজা সাহেবের সহচার্যে হাফলংয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। হাফলংয়ে এক মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে কমলপুর সীমান্তে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সিলেট অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল ধলাই ক্যাম্প। ধলাই ক্যাম্প অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান। ধলাই সীমান্তের ওপারে ছিল কমলপুর। পরে কৃষ্ণ কুমার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চলে আসেন তিলকপুর গ্রামে। ওই দলটি কামরছড়া পাক বাহিনীর ক্যাম্প বেশ কয়েকটি চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বীরসেনানী বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগে চাকরি পান।

বাবু সেনা সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তর ভানুবিল গ্রামের বাবু সিংহ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের এপ্রিল মাসে শমসেরনগরের কাছে কামারছড়ায় পাকবাহিনী ক্যাম্প স্থাপনের পর ভানুবিল গ্রামের অন্যান্য যুবকের সঙ্গে পাক সৈন্যরা বাবু সেনা সিংহকেও জোর করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তাদের প্রতিদিন বাঙ্কার খননের কাজে লাগানো হয়। একদিন সুযোগ বুঝে বাবু সেনা সিংহ আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যান ভারতে। তিনি শিলচর লেয়ার বনে তদানীন্তন মেজর সি আর দত্তের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানের অধীনে কমলপুর ধলাই সীমান্তে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এখানে যুদ্ধে মাইন বিস্ফোরণে বেশ ক’জন পাক সৈন্য হতাহত হয়। সেনা সিংহ এ অপারেশনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও অপারেশনেও অংশগ্রহণ করেন।

সতীশ চন্দ্র সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামের মুরুলী চান সিংহের পুত্র সতীশ চন্দ্র সিংহ। একাত্তর সালে তিনি শ্রীমঙ্গল কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। শ্রীমঙ্গল শহরে পাকিস্তানি বাহিনী অবস্থান গ্রহণের পরদিন সতীশ চন্দ্র সিংহ মুক্তিযোদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশে ভারতে চলে যান। ত্রিপুরায় বিদ্যানগর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে গিয়ে মুজিব বাহিনীতে যোগ দেন। মি. ভি কৃষ্ণন নামে ভারতীয় সামরিক অফিসারের অধীনে আসামের লোয়ার হাফলংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি।

গেরিলা প্রশিক্ষণে তিনি এলএমজি চালনা, গ্রেনেড নিক্ষেপ, এসএলআর, টাইম বোমা, স্টেনগান, অ্যামবুশ ও রাইফেল চালানোর শিক্ষা নেন। জুলাই মাসে ক্যাপ্টেন ফখরুলের অধীনে মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসেবে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। পাত্রখোলা সীমান্তে তারা পর পর তিন রাত যুদ্ধ করেন। এ যুদ্ধে অনেক পাক সৈন্য হতাহত হয়। ২৮ জুলাই সতীশ চন্দ্র সিংহসহ মুজিব বাহিনী কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগর এলাকার একটি অপারেশনে অংশ নেন। বীর মুক্তিসেনানী সতীশ চন্দ্র সিংহ দেশের অভ্যন্তরে আরও বেশ কিছু স্থানে যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

ব্রজমোহন সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার ছড়া পাথারি গ্রামের শ্রীবটা সিংহের পুত্র ব্রজমোহন সিংহ। একাত্তরে ব্রজমোহন সিংহ তার নিজস্ব যৎসামান্য জমিতে কৃষি কাজ করে জীবনযাপন করতেন। একাত্তরের মে মাসের এক দিন ব্রজমোহন সিংহ নিজের জমিতে হাল চাষ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পাকবাহিনী তাকে আটক করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পুরো দিন তাকে ক্যাম্পে আটকে রাখার পর পাক অধিনায়ক তাকে গুলি করে হত্যার আদেশ দেন।

ব্রজমোহন সিংহকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাকবাহিনী তার চোখ বেঁধে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে গাড়ি যোগে একজন পাক মেজর সে স্থানে উপস্থিত হন, ব্রজমোহন মনিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া সম্প্রদায়ের লোক বুঝতে পেরে ওই মেজর হত্যা না করে তাকে দিয়ে বাঙ্কার খননের নির্দেশ দিয়ে ছেড়ে দেন।

কিন্তু পরদিন তিনি ছনগাঁও হয়ে জঙ্গলের পথে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। ব্রজমোহন সিংহের মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণের কথা শুনে শত্রুরা তার বাড়ি দখল করে নেয়।

ব্রজমোহন সিংহ লোয়ার হাফলংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ক্যাপ্টেন আবদুস সালামের অধীনে সিলেট শহরে অপারেশনে অংশ নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমানে অধীনে কৈলাশহর ও কমলপুরে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন।

বিশ্বম্ভর সিংহ : কমলগঞ্জ উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশ^ম্ভর সিংহ। একাত্তরের এপ্রিল মাসে তিনি ভারতে গিয়ে মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন ধীর সিংয়ের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

তিনি কমান্ডার হাবিবুর রহমানের অধীনে চাতলাপুরে সীমান্তে অপারেশনে ডিফেন্সে কাজ করেন। বিওপি কামারছড়া চাতলাপুরে তিনি অপারেশন ডিফেন্সের গুরুদায়িত্ব পালন করেন।

মনিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়াদের মধ্যে আরও যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামের রবীন্দ্র সিংহ, ভানুবিল গ্রামের কুলেশ্বর সিংহ, মানত্রী সিংহ, মাধবপুর গ্রামের কৃষ্ণু সিংহ, গিরিন্দ্র সিংহ, বালিগাঁও গ্রামের বাপ্পী সিংহ, আনন্দ সিংহ, সুরমনি সিংহ, ব্রজেন্দ্র সিংহ, গোলের হাওর গ্রামের পদ্মাসন সিংহ, ছড়া পাথারি গ্রামের দিলীপ সিংহ ও তেইগাঁও গ্রামের নন্দেশ্বর সিংহ।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব দেশপ্রেমিক মানুষের অংশগ্রহণ ছিল, তাদের কেউ কেউ মূল্যায়িত হয়েছেন আবার অনেকে রয়ে গেছেন মানুষের অগোচরে। যুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অবদানের কথা সারা দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের সাহসী ভূমিকার কথা মানুষ জানতে পারত।

ইসমাইল মাহমুদ : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper