ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘মেরুদণ্ড’ সোজা রাখা ইতিহাসের শিক্ষা

শুভ কিবরিয়া
🕐 ৯:০২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০১৮

১৯৫৪ সাল আমাদের এই ভূ-খণ্ডের রাজনীতির জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার দম্ভ যে চিরস্থায়ী নয় আর জনগণকে অবজ্ঞা করলে, হেয় করলে যে তার জবাব একদিন না একদিন মেলে সেই রাজনৈতিক শিক্ষা এসেছিল এই বছরেই। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ গো-হারা হেরে এই ভূ-খণ্ডের রাজনীতি থেকে তাদের কর্তৃত্ব হারায় চিরতরে।

যুক্তফ্রন্ট এ নির্বাচনে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মুসলিম লীগের অভাবনীয় ক্ষমতাধর নেতা-কর্মী-পাণ্ডা-মাস্তান আর চাটুকারদের দম্ভ চূর্ণ হলেও তার রেশ টিকে থাকে আরও বেশকিছু বছর। কিন্তু এ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের বছরেই তাদের ভরাডুবি তাদের পাপের শাস্তি হিসেবে এবং পতনের সূচনাকাল হিসেবে চিহ্নিত হয়।
ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়টির একটি নতুন বয়ান হাজির হয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর লেখা সম্প্রতি প্রকাশিত ‘তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫৪’ বইয়ে।
এ ডায়েরি নানা কারণে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস পাঠের এক নতুন দিকচিহ্ন। এ ডায়েরিতে ২৭ এপ্রিল ১৯৫৪, মঙ্গলবার অন্য বয়ানের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ লিখছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নাচোল বিদ্রোহের নেতা ইলা মিত্রকে দেখার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি লিখছেন, ‘বিকেল সোয়া পাঁচটায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম।ৎ
আবু মণ্ডল ও ইলা মিত্রকে দেখলাম। ইলা মিত্র নাচোলের ডাকাতি মামলার রাজনৈতিক আসামি। তিনি পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার। তার ওপর অমানবিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। তার ওপর সমস্ত বর্বর ও অশোভন কর্মকাণ্ড চালানো হয়েছে। গত সাড়ে চার বছর ধরে তিনি মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন। গত ছয় মাস ধরে তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছেন কিন্তু অবস্থার উন্নতির কোনো চিহ্ন নেই। আমি তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখলাম। শুধু হাড্ডি ও চামড়া দলা পাকানো সাদা কিছু।’
পাকিস্তানি শাসক শ্রেণি তখন যে ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠেছে, তার বড় প্রমাণ ইলা মিত্রের ওপর এ বর্বর অত্যাচার। সেই বর্বরতা যে কি বীভৎস, অসভ্য, মায়াহীন, পৈশাচিক হয়ে ওঠেছিল তার একটা বর্ণনা ইলা মিত্র দিয়েছিলেন আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দিতে। সেই জবানবন্দি পাঠ করলে বোঝা যায় মেরুদণ্ড সোজা রাখা নীতিবান মানুষের শিরদাঁড়ার জোর কোথায়। বোঝা যায় নৈতিকতা আর আদর্শ মানুষকে কতটা লক্ষ্যস্থির রাখে। আর বোঝা যায় নৈতিক মানুষ দেখলে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি।

দুই.
কোনো ভনিতা ছাড়াই ইলা মিত্রের জবানবন্দি পাঠ করা যায়। অবশ্য ভনিতা একটা আছে, সেটা হচ্ছে, এ জবানবন্দি ন্যাংটো করে দেয় ফ্যাসিবাদী শাসকের ভয়ার্ত আর উন্মাদ চেহারাকে। ‘কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭-১-১৯৫০ তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেপ্তার হই এবং পরদিন আমাকে নাচোলে লইয়া যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধর করে এবং তাহার পর আমাকে একটি সেলের মধ্যে লইয়া যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার না করিলে আমাকে উলঙ্গ করিয়া দেওয়া হইবে এই বলিয়া এসআই আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলিবার মতো কিছু ছিল না, কাজেই তাহারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলিয়া নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করিয়া রাখে।
আমাকে কোনো খাবার দেওয়া হয় নাই, একবিন্দু জল পর্যন্তও না। সেই দিন সন্ধ্যা বেলাতে এসআইয়ের উপস্থিতিতে সিপাইরা তাহাদের বন্দুকের বাট দিয়া আমার মাথায় আঘাত করিতে শুরু করে। সেই সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়িতে থাকে। ইহার পর আমার কাপড়-চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় ১২টার সময় সেল হইতে আমাকে বাহির করিয়া সম্ভবত এসআইয়ের কোয়ার্টারে লইয়া যাওয়া হয়। তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না।
যে কামরাটিতে আমাকে লইয়া যাওয়া হইল, সেইখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাহারা নানা রকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালাইল। দুইটি লাঠির মধ্যে আমার পা দুইটি ঢুকাইয়া চাপ দেওয়া হইতেছিল এবং সেই সময় আমার চারি ধারে যাহারা দাঁড়াইয়াছিল তাহারা বলিতেছিল যে, আমাকে ‘পাকিস্তানি ইনজেকশন’ দেওয়া হইতেছে। এ নির্যাতন চলিবার সময় তাহারা একটি রুমাল দিয়া আমার মুখ বাঁধিয়া দিয়াছিল। জোর করিয়া আমাকে কিছু বলাইতে না পারিয়া তাহারা আমার চুলও উপড়াইয়া ফেলিয়াছিল। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করিয়া সেলে ফিরাইয়া লইয়া গেল, কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে হাঁটা সম্ভব ছিল না। সেলের মধ্যে আবার এসআই, সিপাইদের চারটি গরম সিদ্ধ ডিম আনিবার হুকুম দিল এবং বলিল ‘এইবার সে কথা বলিবে’।
তাহার পর চার পাঁচজন সিপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরিয়া চিৎ করিয়া শোয়াইয়া রাখিল এবং একজন আমার যৌন অঙ্গের মধ্যে একটি গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকাইয়া দিল। আমার মনে হইতেছিল, আমি যেন আগুনে পুড়িয়া যাইতেছি ইহার পর আমি অজ্ঞান হইয়া পড়ি।
৯-১-১৯৫০ তারিখের সকালে যখন আমার জ্ঞান হইল, তখন উপরোক্ত এসআই এবং কয়েকজন সিপাই আমার সেলে আসিয়া তাহাদের বুট দ্বারা আমার পেটে লাথি মারিতে শুরু করিল। ইহার পর আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে পেরেক ফুটাইয়া দেওয়া হইল। সেই সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়িয়া থাকিয়া আমি এসআইকে বিড়বিড় করিয়া বলিতে শুনিলাম, ‘আমরা আবার রাত্রে আসিতেছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করো তাহা হইলে সিপাইরা একে একে তোমাকে ধর্ষণ করিবে।’ গভীর রাত্রিতে এসআই এবং সিপাইরা ফিরিয়া আসিল এবং পুনরায় সেই হুমকি দিল। কিন্তু আমি যেহেতু তখনো কিছু বলিতে রাজি হইলাম না, তখন তিন-চারজন আমাকে ধরিয়া রাখিল এবং একজন সিপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করিতে শুরু করিল। ইহার অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িলাম।
পরদিন ১০-১-১৯৫০ তারিখে যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিল তখন আমি দেখিলাম আমার দেহ হইতে দারুণভাবে রক্ত ঝরিতেছে এবং আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণ ভিজিয়া গিয়াছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল হইতে নবাবগঞ্জ লইয়া যাওয়া হইল। নবাবগঞ্জ জেলগেটের সিপাইরা জোরে ঘুষি মারিয়া আমাকে অভ্যর্থনা জানাইল। সেই সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটি সেলের মধ্যে বহন করিয়া লইয়া গেল। তখনো আমার রক্তপাত হইতেছিল এবং বেশ জ্বর ছিল। সম্ভবত নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় জ্বর দেখিয়াছিলেন ১০৫ ডিগ্রি। যখন তিনি আমার কাছে দারুণ রক্তপাতের কথা শুনিলেন, তখন তিন আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, একজন মহিলা নার্সের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হইবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরা কম্বল দেওয়া হইল।
১১-১-১৯৫০ তারিখে সরকারি হাসপাতালে নার্স আমাকে পরীক্ষা করিলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়াছিলেন, সেইটি আমি জানি না। তিনি আসিবার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিল তাহা পরিবর্তন করিয়া পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হইল। এ সময়টিতে আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব জ্বর ছিল। তখনো আমার দারুণ রক্তপাত হইতেছিল এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হইয়া যাইতেছিলাম।
১৬-১-১৯৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটি স্ট্রেচার লইয়া আসা হইল এবং আমাকে বলা হইল যে, পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্য জায়গায় যাইতে হইবে। খুব বেশি শরীর খারাপ থাকিবার জন্য আমার পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব নয়, এ কথা বলায় লাঠি দিয়া আমাকে আঘাত করা হইল এবং স্ট্রেচারে উঠিতে বাধ্য হইলাম। ইহার পর আমাকে অন্য এক বাড়িতে লইয়া যাওয়া হইল। আমি সেইখানে কিছুই বলি নাই, কিন্তু সিপাইরা জোর করিয়া একটি সাদা কাগজে আমার সই আদায় করিল। তখন আমি অর্ধচেতন অবস্থায় খুব বেশি জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাইতেছিল সেজন্য পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হইল। ইহার পর যখন আমার শরীরের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হইল, তখন আমাকে ২১-১-১৯৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ হইতে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আনিয়া সেইখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল। কোনো অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলি নাই এবং উপরে যাহা বলিয়াছি তাহার বেশি আমার আর বলিবার কিছু নাই।’
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারি ১৯৫০ সাঁওতাল চাষিরা জোরপূর্বক জোতদারদের জমির ধান কাটতে গেলে স্থানীয় নাচোল থানার এএসআই তফিজুদ্দিন আহমদ কয়েকজন কনস্টেবলসহ অকুস্থলে গমন করেন। সংঘর্ষের পরিণামে সাঁওতাল চাষিরা সশস্ত্র বিপ্লবের বিভিন্ন ধ্বনি দিতে দিতে এএসআই তফিজুদ্দিন ও তিনজন কনেস্টেবলকে আক্রমণ করে। সাঁওতাল চাষিরা রাইফেল কেড়ে নেয়, তাদের হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখে। ঘটনার পরই ইলা মিত্রের স্বামী হাবুল মিত্র সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ চলে যান। ৭ জানুয়ারি (১৯৫০) সাঁওতাল বেশে রোহনপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ইলা মিত্র গ্রেপ্তার হন।

তিন.
গত বেশকিছু দিন ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষের সমর্থক শিক্ষার্থী, শিক্ষকরা সরকারের রোষানলে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। রাষ্ট্র, সরকার, সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ ন্যক্কারজনক কাজের অন্যতম সহায়ক হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, সরকারি দল ও জোটের সমর্থক শিক্ষকরা। বিশেষত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটলেও রাজনৈতিকভাবে সরকারের সমর্থক শিক্ষদের এক ধরনের নিস্পৃহা ও নীরবতা সমাজকে বিষ্মিত করেছে। সরকার সমর্থক দেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কথিত বিবেকবানদের নীরবতাও লক্ষ্যণীয়। অবশ্য এর বাইরে হাতে গোনা কিছু শিক্ষক সব লোভ, ভয়, হুমকি উপেক্ষা করে নীতির প্রশ্নে মেরুদণ্ড সোজা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এ ভীষণ হতাশার কালে সেটাই হয়তো আশার আলো।

চার.
এ লেখাটা শুরু করেছিলাম ১৯৫৪ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বয়ান দিয়ে। মানুষের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদ সে সময় জেগে ওঠছে কেবল। মানবিক বিবেচনায় ফ্যাসিবাদের উত্থানকাল কি রকম হিংস্র হয়ে ওঠে তার প্রমাণ তখনকার সরকারের প্রশাসনের হাতে ইলা মিত্রের নিপীড়ন। সে সময়ের পুলিশ, প্রশাসন, জেল কর্তৃপক্ষ, মেডিকেল কলেজপ্রশাসন সবাই বিবেকরহিতভাবে ফ্যাসিবাদের নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়। কিন্তু সেই ঘোর অন্ধকারকালে সব রকম বর্বরতা সত্ত্বেও ‘শিরদাঁড়া’ খাড়া করে ইলা মিত্র ইতিহাসের সামনের কাতারের মানুষ হয়ে দাঁড়ান।
সেই শিরদাঁড়া সোজা করা মানুষকেই ইতিহাস শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেছে। নিপীড়কের জন্য রেখেছে ঘৃণা। আবার নিপীড়ক, জনবিরোধী সেই রাজনীতিরও মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা ইতিহাসের অংশ হয়, ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা নেয় না।

শুভ কিবরিয়া : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক
ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]

 
Electronic Paper