বাঁচায় নদী, বাঁচাও নদী
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নদী রক্ষা জরুরি
তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ৮:৫৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০১৮
আমাদের দেশে নদীর প্রতি যত্ন নেই। অনেক নদী খননের অভাবে প্রাণ হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। বর্ষাকালে নদী যখন দুপাড় ভাঙে তখন ভেঙে যাওয়া মাটিগুলো দিয়ে নদী ভরাট হয়। ভরাট হওয়া স্থানগুলো খননের মাধ্যমে গভীর করা প্রয়োজন।
খনন করা হয় না বলে, পরবর্তী বছরে যখন বর্ষা মৌসুমে নদী ভরে যায়, তখন গভীরতা না থাকার কারণে নদীর দুপাড় ভাঙতে থাকে। যেহেতু গভীরতা কম, তাই পাড় ভেঙে ভেঙে নদী তার স্থান তৈরি করে নেয়। তখন নদী বাঁক পরিবর্তন করে এবং নতুন নতুন এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়। সে কারণে নদী প্রস্থে বাড়ে গভীরতায় কমে। নদী যে অমূল্য সম্পদ আমরা সেই সম্পদের ব্যবহারই শিখিনি। নদী যে শুধু বর্তমানের জন্য নয়, ভবিষ্যতেরও তা আমরা ভুলতে বসেছি।
আমাদের দেশে যখন বন্যা দেখা দেয় তখন শুরু হয় তৎপরতা। বন্যার মৌসুম শেষ হলে আমরা আবার ভুলে যাই নদীর কথা। নদীকে কেন্দ্র করে একদল অসাধু কর্তাব্যক্তি বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। আমাদের দেশীয় তত্ত্বাবধানে অনেক নদীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আবার অনেক নদী আছে যেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নিজস্ব তত্ত্বাবধান ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন।
যে হারে আমাদের নদীগুলো একের পর ধ্বংস হচ্ছে, এ রকম যদি চলতেই থাকে তাহলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। সামান্য সাবধানতার অভাবে আমাদের ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে। আমাদের সেই সময় খুব দূরবর্তী নয় যখন আমরা বলব একদা নদীমাতৃক ছিল আমাদের দেশ।
চোখের সামনে দেখতে দেখতে কত নদীর মৃত্যু হচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই। মৃত্যু তো নয়, অপমৃত্যু। নদীর এ মৃত্যুর দায় আমাদের সবাইকে নিতে হবে। আমাদের দেশপ্রেম কি তবে লৌকিকতা মাত্র! দেশপ্রেম লোকিক-সেটা সত্য হোক, তাও চাই না। আমরা বরং দেখতে চাই, আমাদের দেশপ্রেম আমাদের রক্তগত-মজ্জাগত।
আমরা আমাদের মায়ের মতো দেশকেও ভালোবাসি। মায়ের মলিন মুখ যেমন আমাদের অস্থির করে তোলে, তেমনি আমাদের নদীর অপমৃত্যুতে দেশমাতার যে মলিন মুখ তার জন্যও আমাদের কষ্টের উপলব্ধি একই হওয়া বাঞ্ছনীয়। যদি আমরা আমাদের নদীগুলোকে হারাই তাহলে আমাদের জীববৈচিত্র্যে যে নেতিবাচক ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে তার অশুভ পরিণত আমাদের সন্তান কিংবা তার সন্তানের ওপরই পড়বে। তাই নদীকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে আমাদের প্রজন্মকেই বাঁচিয়ে রাখা।
নদীর দুই মৌসুমে দুই রূপ। শুষ্ক মৌসুমে নদী যেমন ধূ-ধূ বালুচর হয়ে ওঠে, আবার বর্ষা মৌসুমেও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। আবার উভয় মৌসুমেই নদী আমাদের জন্য অতীব জরুরি। এক অর্থে নদী বারো মাসেই আমাদের জীবনের জন্য ভয়ঙ্কর আবার বারো মাসই আশীর্বাদ। আমরা যদি নদীকে কাজে লাগাতে চাই, নদী তখন আমাদের জীবনের জন্য খুবই বন্ধুত্বসুলভ। আর যদি আমরা নদীর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করি তাহলে নদী আমাদের জন্য শত্রু। এক কথায় বলা যেতে পারে নদীকে ভালোবাসা দিলে সে প্রতিদান দেয়, আবার ভালোবাসা না দিলে ভালোবাসা প্রদর্শন করে না। এমনকি ভালোবাসা না দিলে নদী শত্রুতে পরিণত হয়।
নদীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন মানে শুধু কবিতায় উপমাবন্দী করেই দায়িত্ব শেষ করা নয়। নদীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যখন সভ্যতার নামে নদী হত্যা ছিল না তখন নদী তার স্বাভাবিক গতিতে পথ তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু এখন নদীর জন্য সেই বাস্তবতা নেই। এখন নদী চাইলেও নিজস্ব পথরেখা তৈরি করে নিয়ে চলতে পারে না। ব্রিজ-কালভার্ট বিভিন্ন রকম বাঁধ বানিয়ে নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে জন্য নদীর পানিপ্রবাহকে ঠিক রাখার জন্য নদী খনন করতে হবে।
যদি নদী খনন করা হয় তাহলে সেই গভীরতা ধরে নদী প্রবাহিত হবে। নদীর জন্য আমরা যদি পথ ঠিক করে দিই তাহলে বারো মাসেই নদীকে বন্ধু হিসেবে পেতে পারি। যেমন, বর্ষা মৌসুমে নদী আর সহজে পাড় ভাঙবে না। কারণ নদীর পাড় ভাঙার কারণই তো তখন থাকছে না। আমরা নদী খনন করি না বলে ভরাট নদীর দুকূল ভেঙে প্রবাহিত হয়। এতে করে গ্রামের পর গ্রাম নদীগর্ভে বিলীর হয়।
এখনো সময় আছে আমাদের দেশের নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার। সময় থাকতেই যদি আমরা নদীগুলো বাঁচাতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে। শুধু বর্তমানের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও আমাদের নদী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। নদী রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, সব জনগণের।
তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, রিভারাইন পিপল
[email protected]