ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অবশেষে দেশি পেঁয়াজ রক্ষায় গুদাম

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ৯:১৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯

কৃষিকে সুরক্ষা করে কৃষককে বাঁচাতে হবে। কোনো কারণে এর ব্যত্যয় হলে কৃষি ও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এই অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে কৃষির উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে পরিকল্পিত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেন কৃষক পণ্য উৎপাদন করে উপযুক্ত মূল্যে তা বিক্রি করতে পারে।

আমাদের দেশে অনেক সময়ই কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। একটু বাড়তি ফলন হলেই কম মূল্যে চাষিরা ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলে চাষিদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। আবার কোনো পণ্যের সংকট হলে সে পণ্য তাদের বাড়তি মূল্যে কিনে খেতে হয়।

কিছুদিন ধরে পেঁয়াজের অস্থির বাজারের কারণে ভোক্তার কষ্ট বেড়েছে। যা সামাল দেওয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পরও কোনো সুফল আসছে না। ইতিমধ্যেই পেঁয়াজ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু ভোক্তার কষ্ট লাঘব হয়নি। প্রচুর পরিমাণ পেঁয়াজ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি হয়েছে। এমনকি ভোক্তার কষ্ট লাঘবে সরকার বাড়তি ভাড়ায় কার্গো বিমানে পেঁয়াজ আমদানি করেও শেষ রক্ষা করতে পারছে না। মূলত ভারতই ঘাটতি পেঁয়াজের মূল বাজার ছিল।

প্রতি বছরই দেশীয়ভাবে উৎপাদনের পর ঘাটতি পেঁয়াজ ভারত থেকেই আমদানি করা হতো। এ বছরও ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। কিন্তু ভারতে পেঁয়াজের ফলনে বিপর্যয় ঘটায় তারা দেশীয় ভোক্তার স্বার্থে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ নিজের কষ্ট বাড়িয়ে অন্যের উপকার কেউ তো করবে না। এখন ভারতেও পেঁয়াজের বাজার চড়া। সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম বাড়ার প্রতিবাদে ভারতের পার্লামেন্ট ভবন প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেছে বিরোধী দল কংগ্রেস। সদ্য কারামুক্ত কংগ্রেস নেতা ও সাবেক মন্ত্রী পি. চিদাম্বরম এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন।

যে কোনো দেশের সরকার ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে যে কোনো পণ্য আমদানি কিংবা রফতানি করে থাকে। পণ্যের সংকট দেখা দিলে আমদানি করে, আর উদ্বৃত্ত পণ্যের বাজার রক্ষায় পণ্য রফতানি করে, এটাই বাজার অর্থনীতি। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও তাই। ভারত পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত দেশ। ফলে ভারত প্রতি বছরই পেঁয়াজ রফতানি করে। আর ভারতের পেঁয়াজের বড় বাজার ছিল বাংলাদেশ। আমাদের দেশের পেঁয়াজ আমদানিকারকরা ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতেন। কিন্তু এ বছর তারা পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করেও তা ধরে রাখতে পারেননি।
এ বছর ভারত সরকার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত সফরকালে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সে সময় ভারত আশস্ত করেছিল, পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা প্রত্যাহার হয়নি। সংগত কারণে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে আগুন লাগে। যা নিয়ে সরকারকেও বিব্রত পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। কিন্তু উপায় কী? দেশীয় পেঁয়াজ উঠতে আরও সময় লাগবে। আর চাষের জমিতে নতুন পেঁয়াজ এখনও পরিপক্ক হয়নি। পেঁয়াজ চাষিরা বেশি দামের আশায় অপরিপক্ক পেঁয়াজ জমি থেকে উঠিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন।

বাড়তি দামের আশায় কৃষকরা অপরিপক্ক পেঁয়াজ ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে বিক্রি শুরু করায় সরকার উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। গত ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সেচ ভবনে ‘কৃষি বাজার’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। বাস্তবে তাই, পেঁয়াজ চাষিরা এখন বাড়তি দামের আশায় অপরিপক্ক পেঁয়াজ উত্তোলন করায় শেষ পর্যন্ত হয়তো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। অথচ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশি পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

তবে, দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গুদাম নির্মাণের উদ্যোগকে আমরা ইতিবাচকই বলব। কারণ, পেঁয়াজ চাষিরা মৌসুমের শুরুতে মাত্র ১৫-২০ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হন। সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত গুদাম নির্মাণ হলে পেঁয়াজ চাষিরা মৌসুমের শুরুতে কম দামে বিক্রি না করে তা গুদামে সংরক্ষণ করতে পারবেন। এতে চাষিরা উপকৃত হবেন। শুধু পেঁয়াজ কেন, অন্যান্য সবজিও সংরক্ষণ উপযোগী গুদাম নির্মাণ করা উচিত।

কৃষিনির্ভর আমাদের দেশ। কৃষির উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে পারলে চাষিদের ক্ষতির মুখ থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে। টমেটো, সিম, মুলা, মরিচ, লাউ, কুমড়া, আলু ও সবজি জাতীয় নানা পণ্য মৌসুমের শুরুতে চাষিরা পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এমনকি অনেক সময় ক্ষেতেই সবজি নষ্ট করে দেন, গরু ছাগলকে খাওয়ান। অথচ এসব পণ্য মৌসুমের শুরুতে চাষিরা গুদামে সংরক্ষণ করতে পারলে সারা বছরের ভোক্তার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এমনকি দেশীয় চাহিদা পূরণ করে কোনো কোনো পণ্য বিদেশে রফতানি করাও সম্ভব। কারণ, এখন সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অর্জন পাহাড়সমান। পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ নিতে পারলে সবজি হতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার।

এ বছর পেঁয়াজের মাত্রাতিরিক্ত মূল্য এবং বিদেশ থেকে আমদানি জটিলতার কারণে সরকার পেঁয়াজ সংরক্ষণ উপযোগী গুদাম নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার মনে করছে, মৌসুমের শুরুতে চাষি পর্যায়ে পেঁয়াজ কিনে সংরক্ষণ করবেন। কোনোভাবে কেউ যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পেঁয়াজের বাজারকে অস্থির করে তুলতে না পারে। অবশ্যই সরকারের এ পদক্ষেপ সফল করে তুলতে হবে। যদি দেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হয়, তাহলে জিটুজি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ আমদানি করে গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলে আগামীতে পেঁয়াজকে নিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না। অর্থাৎ ভোক্তার কষ্ট লাঘব করা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে টিসিবির কর্মকর্তারা জানান, চাল, ডাল, গম, ধান, তেল ও আলু সংরক্ষণের উপযোগী গুদাম রয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজ ও সবজি সংরক্ষণের জন্য কোনো গুদাম না থাকায় অনেক সময়ই ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এতে ভোক্তার গলা কাটা যায়। আর পোয়াবারো হয় ব্যবসায়ীদের। সংস্থাটির কর্মকর্তারা মনে করেন, সবজি সংরক্ষণের গুদাম নির্মাণ করা হলে মৌসুমে কৃষককে যেমন কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হবে না, তেমনি মৌসুম শেষে ব্যবসায়ীরা চাইলেও দাম বাড়াতে পারবে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিসিএস) তথ্য মতে, দেশে এখন বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৪-২৫ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় ১৮ লাখ টন। চাহিদার বাকি ৬ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ প্রতি বছরই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

এমনকি সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় প্রতি বছর কৃষকের উৎপাদিত ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পেঁয়াজ পচে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে পেঁয়াজের মতো পচনশীল পণ্য সংরক্ষণের এ উদ্যোগকে আমরা যৌক্তিক ও সময়োচিত বলে মনে করি। গোটা দেশেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ উপযোগী গুদাম নির্মাণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যায়ক্রমে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী গুদাম সারা দেশেই নির্মাণ করা সম্ভব হলে পেঁয়াজ ও সবধরনের সবজি চাষিরা ভাড়ায় সবজি সংরক্ষণ করে ক্ষতির মুখ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন, এটাই বাস্তবতা।

আব্দুল হাই রঞ্জু : কলাম লেখক
[email protected]

 

 

 
Electronic Paper