ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দিন শেষে আমরাই অপরাধী!

সোলায়মান মোহাম্মদ
🕐 ৯:০২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১০, ২০১৯

জামালপুরের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) আহমেদ কবীরের আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ভালো গান করতেন, খুব মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, পরোপকারীও ছিলেন বৈকি। যাকে শুদ্ধাচারের সনদ দেওয়া হয়েছিল ঠিক তার মাঝেই অশুদ্ধতা ভরপুর দেখা দিল। যে কারণে কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার সেই শুদ্ধাচার সনদ।

প্রমাণিত হয়েছে, তিনি একজন আপাদমস্তক অশুদ্ধ মানুষ। কিন্তু কখন প্রমাণিত হলো যে তিনি অশুদ্ধ মানুষ? যখন নারী অফিস সহকারীর সঙ্গে আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ হলো। আবার দেখুন, ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল সিরাজুদ দৌলা সমাজের সবচেয়ে সম্মানী মানুষ ছিলেন। শিক্ষাগুরু, জাতি গড়ার কারিগর ছিলেন। সমাজের নানা আচার-অনুষ্ঠানে যাকে সবার আগে বসতে চেয়ার দিতে হতো।

সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিটির অবয়ব থেকেও কিন্তু পৃথিবীর সব থেকে নোংরা মানুষের পরিচয়টি বের হয়েছে। যা কারও কল্পনাতেও ছিল না। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ওই ঘটনায় ১৬ জন আসামিকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ দেখুন ওই ১৬ জনের প্রত্যেকেই কিন্তু যার যার অবস্থানে সম্মানি ব্যক্তিবর্গ ছিলেন।

সম্প্রতি দেশের প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বুয়েটে হত্যা করা হলো আবরারকে। যারা হত্যা করল তারাও একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সহপাঠী। ওখানে যারা পড়ে নিঃসন্দেহে প্রখর মেধাবী। অথচ যা ঘটল তা এখনো মেনে নিতে পারছি না। এই প্রখর মেধাবীরাই নিজেদের বন্ধুকে বীভৎসভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করল। আহ! কী পৈশাচিক অপরাধযজ্ঞ। পুরো জাতি এমন যজ্ঞে বাকহীন। এবার ভেবে বলুন তো, ওরা কি রাতারাতিই অপরাধী হয়ে উঠেছে, নাকি আগে থেকেই অপরাধী ছিল? নিশ্চয়ই বলবেন আগে থেকেই এরা অপরাধী ছিল। এরা নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল।

এই যে অতিসম্প্রতি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষকে কিছু শিক্ষার্থী পানিতে নিক্ষেপ করল এরাও কি একদিনের মধ্যেই অপরাধী হয়েছে? প্রশ্নই আসে না। যারাই অপরাধ করছে, ছোট বা বড়, যেখানেই করছে মূলত কেউই মুহূর্তের মধ্যে অপরাধী হয়ে উঠে না। আবার এদের কেউ এলিয়নও নন। ভিনগ্রহ থেকে এসে কেউ অপরাধ করছে না। বরং আমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ একের পর এক অপরাধ ঘটিয়ে চলছে। আজকে স্বজনের হাতে স্বজন খুন হচ্ছে। বাবা মায়ের কোল সন্তানের জন্য খুব নিরাপদ স্থান অথচ এখানেও অনিরাপত্তার স্পষ্ট ছাপ দেখা মিলল।

এমনকি গত কয়েক দিনে পত্রিকায় যা পড়লাম তাতে কয়েকটি ঘটনা এমনও পেলাম যে বাবা কর্তৃক নিজের মেয়ে শিশু ধর্ষিত। আবার এটাও পড়লাম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানের হাতে শিক্ষক পিতা খুন। সুতরাং বলা যায় আপনজনদের কাছেই আপনজনেরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। স্বার্থ হাসিলের জন্য সর্বপ্রথম আপনজনকেই আঘাত করা হচ্ছে। একই কক্ষে এমনকি একই খাটে দীর্ঘদিন বসবাস। হঠাৎ রূপের পরিবর্তন। বলা যায় ভালোমানুষের চাদরে লুকিয়ে থাকা খারাপ মানুষের বসবাস। অপরাধ প্রকাশ হওয়ার পর খোলস উন্মোচন হয় যে, সে বা তারা খারাপ মানুষ। আবার কখনো কখনো আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। অনেকেই বলে থাকে সরকার ব্যবস্থার আইনি দুর্বলতা বা শাস্তি না দেওয়ার ফলেই দিনদিন অপরাধ বেড়ে চলেছে। অথচ দলমত নির্বিশেষে একটু ঘেঁটে দেখুন বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া প্রায় সব অপরাধের আইনানুযায়ী শাস্তি হচ্ছে।

একেবারেই তর্কে যেতে চাই না। হয়তো কয়েকটি ঘটনার আজও কোনো বিচার হয়নি। আবার এটাও ঠিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের শাস্তি আরও বাড়ানো উচিত। কিছু পরিবর্তনও আবশ্যকীয়। তবে যাই বলুন, অপরাধীদের শাস্তি হওয়া বা না হওয়ার বিষয়ে আমার ব্যতিক্রমধর্মী একটি বিশ্বাস কাজ করে। যা আপনাদের অনেকের সঙ্গেই মিলবে না। শুধু সরকারি আইনের শাসনব্যবস্থা খুব জোরদার বা যথাযোগ্য শাস্তি হলেই অপরাধ কমে যাবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। আমার বিশ্বাসের পক্ষে খুব বেশি যুক্তিতর্ক দেখাতে হবে না।

সৌদি আরবের শাসনব্যবস্থার দিকে একটু তাকালেই চলবে। আমার চাচাতো ভাই কাজের সুবাদে বেশ কয়েক বছর সৌদি আরবে বসবাস করেছেন। সে প্রায়ই আমাদের বলে, প্রতি শুক্রবারই নাকি সেখানে চুরির অপরাধে প্রকাশ্যে হাত কেটে দেওয়া হয় এবং অবৈধ যৌনাচার বা ধর্ষণের কারণে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এতো কঠিন বিচারব্যবস্থা থাকার পরও কিন্তু সেখানে চুরি ও ধর্ষণের মতো অপরাধ বন্ধ হয়নি।

সুতরাং এ পর্যায়ে দৃঢ়ভাবেই বলা যায়, আইন করে কখনো আইন মানানো যায় না। তাই বলে এটা বলছি না যে, অপরাধের শাস্তি না হওয়াই ভালো; যথাযথ ও কঠিন শাস্তি হোক এটা চাই। সরকার যে আইন করবে সেটা ভেবে-চিন্তে বুদ্ধি খরচ করে ধীরে করুক। তবে শাস্তি যতই কঠিন হোক না কেন, অপরাধ বন্ধ হবে না। অপরাধীদের শুধু শাস্তির ভয় দেখিয়ে অপরাধ থেকে সরিয়ে আনা যাবে না। বেলা গড়িয়েছে অনেক। দেশ স্বাধীন হয়েছে বহু বছরের কথা। আমাদের পরেও অনেকে স্বাধীন পতাকা উড়িয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশকে সব দিক থেকেই গুছিয়ে এনেছেন।

আমরাও আধুনিকায়নে শিল্প-সাহিত্যে কোনো দেশ থেকে পিছিয়ে নেই। উন্নতিতে বহুপথ পাড়ি দিয়েছি। আরও বহুদূর যেতে চাই এবং যেতে হবে। কিন্তু এই যে স্বজন হারাচ্ছি। মেধা বিনাশ হচ্ছে। দিন শেষে এই আমরাই হয়ে উঠছি একেকজন অপরাধী। কাজেই এমতাবস্থায় আমাদের যা করণীয় তা হলো : নিজেদের সন্তানদের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, আইনজীবী, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তোলা অথবা অন্য কোনো পেশার সর্বোচ্চ শিখরে দেখার আগে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

পরিবার থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে সন্তানরা কখনোই মানুষ হবে না, যদি অভিভাবকদের আয়ের পথ হালাল না হয়। হারাম খেয়ে যত বড়ই হোক না কেন এক সময় নিজেরাই নিজেদের মারবে ও মরবে এবং দেশকে রুগ্ন বানিয়ে ছাড়বে। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও নাট্যকার সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার মর্ম কথার মতোই হবে। তখন এই আমরাই আবার বলব প্রখর মেধাবী হয়েছে কিংবা বিখ্যাত হয়েছে বটে; কিন্তু মানুষ হতে পারেনি।

সবশেষের বক্তব্য হলো- সৎ পথে বিবেক খাটিয়ে পরিশ্রম করতে হবে। শত কষ্টেও ভুলপথে অর্থলাভ করা যাবে না। সুদ-ঘুষ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, অনৈতিক পথের আয়ে জীবিকা নির্বাহ করে সাময়িক বিখ্যাত হলেও ধ্বংস অনিবার্য।

সোলায়মান মোহাম্মদ : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper