ভার্চুয়ালের পথে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
ড. এম এ মাননান
🕐 ৯:৫৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৮
শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বদলে যাওয়া উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ‘ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপান্তরিত হওয়ার পথে এগিয়ে চলছে। আধুনিক ও প্রযুক্তিবান্ধব এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন, অবকাঠামো এবং নানা অগ্রগতি আর সম্ভাবনা নিয়ে খোলা কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন উপাচার্য ড. এম এ মাননান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- তানজেরুল ইসলাম
খোলা কাগজ : নানা সংকট মোকাবেলা করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আজ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতি পেয়েছে। উপাচার্য হিসেবে আপনার শুরুর দিকটা কেমন ছিল এবং এখন কী অবস্থায় আছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়?
ড. এম এ মাননান : আমি দায়িত্ব নিয়ে দেখি কোনো রকমে চলছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) কার্যক্রম। একের পর এক শিক্ষা কর্মসূচি বন্ধের পাশাপাশি সারা দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখের মতো। প্রোগ্রাম চালু ছিল মাত্র ১২টি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬ লাখের বেশি। বিএসসি ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, এলএলবি অনার্স, বিবিএ, এমবিএ, বিএসসি ইন এগ্রিকালচার প্রোগ্রামসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর চালু অনার্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলোতে প্রতিযোগিতামূলক লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে অন্য সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। বর্তমানে একাডেমিক স্কুল রয়েছে ৬টি, ফুল টাইম শিক্ষক রয়েছেন ১৩৫ জন, সারা দেশে টিউটর (উপরি) শিক্ষক রয়েছেন ২৬ হাজার ৮০২ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০টি আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রাম (ফরমাল) ও ১৯টি অনানুষ্ঠানিক (নন-ফরমাল) কোর্স চালু রয়েছে। যেখানে ২০১২ সালে প্রোগ্রাম ছিল মাত্র ১২টি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সংগঠনের জন্য সারা দেশে ১২টি রিজওনাল ও ৮০টি সাব-রিজওনাল সেন্টারের পাশাপাশি ১ হাজার ৫০২টি স্টাডি সেন্টার রয়েছে।
ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হতে আর কতটা পথ বাকি?
বাউবিতে অনলাইন সার্ভিস অ্যান্ড পেমেন্ট সিস্টেম (ওএসএপিএস) চালু করা হয়েছে। অনলাইনে নিবন্ধন, পুনরায় নিবন্ধন, ডিজিটাল আইডি অ্যাপ্লিকেশন, মূল সনদের জন্য আবেদন, প্রশংসাপত্রের জন্য আবেদন, নাম সংশোধন, সদৃশ্য সনদ, নিবন্ধনসহ আরও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা স্বল্প সময়ে শিক্ষার্থীরা অনলাইনের মাধ্যমে পাচ্ছে। দেশের বাইরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য স্টাডি সেন্টার খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা পাঠ সামগ্রী তৈরি না করে কোনো প্রোগ্রাম শুরু করি না। আগে পাঠ সামগ্রী শিক্ষার্থীরা সময়মতো পেত না। আমরা নিজেরাই আমাদের টেক্সট বই তৈরি করি। আমাদের ই-বুকের বইগুলো শুধু আমাদের জন্য নয়; সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য।
বাউবির কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কি কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
বাউবির প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের অফিস ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চতুর্থ ব্যাচের ৪৫ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ই-লার্নিং, এলএমএস, শিক্ষায় প্রযুক্তি ব্যবহার, অনলাইন এডুকেশন ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেক শিক্ষক বিদেশ থেকে ই-লার্নিং প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক কর্মকর্তার কম্পিউটারবিষয়ক দক্ষতা পরীক্ষা নিয়মিত নেওয়া হয়ে থাকে। যেসব কর্মকর্তার দক্ষতা কম তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ফের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এ ছাড়া আধুনিক অফিস ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাউবিতে কর্মরত সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ডেন্টাল ক্যাম্প, হেলথ ক্যাম্প করা হয়েছে। বর্ষবরণ, পিঠা মেলা থেকে শুরু করে বাউবিতে ক্যাম্পাসভিত্তিক সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি করা হয়েছে।
বাউবির অবকাঠামো উন্নয়নে আপনার পদক্ষেপ...
অতীতে বাউবিতে কোনো গেস্টহাউস ছিল না, এখন আছে। অতীতে ট্রেনিং কমপ্লেক্স বাতিল করে দেওয়া হলেও এখন আছে। বাউবির ভবনগুলো দ্বিতীয়তলা থেকে চতুর্থতলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুটি আধুনিক ল্যাবরেটরি গাজীপুর ক্যাম্পাসে স্থাপিত হয়েছে। বাউবি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন প্রধান ফটক সবাইকে সহজেই আকর্ষণ করে।
সময়মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বাউবি কতটা সফল?
আমি যোগদানের আগে ২০১৩ সালে ১৮ মাস পর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ফলাফল প্রকাশে দুই মাসের টার্গেট নিয়েছিলাম। এখন ৪০ দিনেই পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হচ্ছে। বাউবিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে। পরীক্ষা পদ্ধতিতেও আধুনিকীকরণ করা হয়েছে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া, আন্দোলনগুলো কীভাবে দেখেন?
দেশের স্বার্থে আন্দোলন হলে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু যারা উসকানিমূলক আন্দোলন করে তা দেশের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি জাতির জন্যও ক্ষতিকর। উসকানিমূলক আন্দোলন আন্দোলনকারীদের জন্যও ক্ষতিকর। কোন দাবি-দাওয়া সরকারের পক্ষে হুট করে মেনে নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। যেই ব্যক্তির শিক্ষার্থীদের পাঠদানের যোগ্যতা নেই তিনিও গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে কয়েক বছর পর এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। অথচ অনেকে অনুমোদন না নিয়েই স্কুল গড়ে তুলেছেন।
বাউবিতে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে...
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কেউ পিএইচডি করতে চাইলে আমরা সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কেউ যদি গবেষণা করতে চান তবে তার জন্য আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পিএইচডি ও গবেষণার জন্য বাউবি পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে।
৬ লাখ শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে আপনার পরামর্শ কি?
যারা বাউবির শিক্ষার্থী হয় তারা অধিকাংশই ঝরে পড়া না হয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধু স্টাডি সেন্টারের ওপর নির্ভর করলে হবে না। আবার অনেকেই স্টাডি সেন্টারেও ঠিকমতো যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের আমরা শিক্ষা উপকরণ দেই, ই-বুক আছে, এসএসসি ও এইচএসসি প্রোগ্রামে বই দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই স্টাডি করে। এতে তারা জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারবে।
সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। একজন ব্যবস্থাপনাবিদ হিসেবে কেমন গাজীপুর মহানগর কেমন দেখতে চান?
নগরপিতার প্রথম কাজ হবে নগরের জন্য একটি সুস্পষ্ট ভিশন তৈরি করা। তিনি এমন ভিশন চিন্তা করবেন যা থেকে বোঝা যাবে তিনি আগামী দিনে তার নগরকে কীরূপ দেখতে চান। এ ভিশনকে সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। নগরীর বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে একটি পাঁচ-বছর মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এ পরিকল্পনার ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে বছর ওয়ারী বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ব্যক্তিদের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। পুরো নগরীর ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ করে জানতে হবে এলাকায় কী কী প্রতিকূল অবস্থা বিদ্যমান; কোথায় কোন সমস্যা রয়েছে, সমস্যা কীভাবে তৈরি হয়েছে, সমস্যার ধরণ কীরূপ এবং সমস্যার পাশাপাশি জানতে হবে এলাকায় কী কী সুযোগ রয়েছে যার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে উন্নয়নকে গতিময় করা যায়। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সব অংশীজনের (এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সরকারি সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা ইত্যাদি) অংশগ্রহণে ওয়ার্কশপের আয়োজন করে তাদের মতামত-পরামর্শ খোলামনে গ্রহণ করে সে তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করা হলে তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবভিত্তিক হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ডের ‘পরিস্থিতি’ ভিন্ন ভিন্ন রকম হওয়ায় ওয়ার্ডভিত্তিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ অপরিহার্য। এ ছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাস্তবানুগ বাজেট তৈরি, অগ্রাধিকার খাতগুলো নির্ধারণ, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাজকর্ম ভালোভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তাদের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৫৭ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে নগর সংক্রান্ত আইনকানুন, বিধিমালা, প্রবিধান, পলিসি, স্ট্র্যাটেজি এবং বাস্তবায়ন নীতিমালাসহ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নগর-অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। টার্গেটের ভিত্তিতে কে কোন কাজটি কত সময়ের মধ্যে সম্পাদন করবে, কত পরিমাণ সম্পদের (অর্থ, জনবল, ইক্যুইপমেন্ট ও অন্য লজিস্টিক্স) দরকার হবে, কর্মসম্পাদন মনিটরিং-মূল্যায়ন কীভাবে হবে, তদারকি কে কীভাবে করবে, কত সময় অন্তর মেয়রের কাছে কর্ম-প্রতিবেদন জমা দিবে ইত্যাদি বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে নিরূপণ করে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা আবশ্যক। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। স্বজনপ্রীতি বা তদবিরের মাধ্যমে অযোগ্য কর্মী নিয়োগ দেওয়া হলে তারা তদবিরের বেড়াজালে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখবে। তাদের দিয়ে ভালো কাজ করানো সম্ভব নয়। বছরে অন্তত দুবার অংশীজনদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে অগ্রগতি বিশ্লেষণ ও বিস্তরণসহ মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ করা হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সহজতর হবে।
এসব কাজে আপাতবিরোধী ব্যক্তিদের বেশি বেশি করে অংশগ্রহণ করাতে হবে যাতে তারা নেতার ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করতে পারে। হয়তো বিরোধিতার রাস্তা থেকেও তারা এক সময় সরে যাবে। এ ছাড়া পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হলে নগরের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ সুচারুরূপে এবং সঠিক সময়ে সম্পন্ন করানো সম্ভব হবে। মেয়র যদি নিজেই নিজের সুপারভাইজার হতে পারেন এবং নিজেই নিজের সমালোচক বনে যান, তাহলে সেটি হবে তার এবং অন্যদের জন্য চমৎকার একটি নজির।
খোলা কাগজ : দৈনিক খোলা কাগজ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. এম এ মাননান : আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য দৈনিক খোলা কাগজকেও ধন্যবাদ।