ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আহা, নদী রে...

আবু আফজাল সালেহ
🕐 ৮:০০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৫, ২০১৯

চীনে একটা প্রবাদ আছে, ‘নদীকে না দেখলে, নদীও তোমায় দেখবে না। আর নদী দেখা বন্ধ করলেই... সব শেষ!’ নদী হচ্ছে সভ্যতার ভরকেন্দ্র। নদীকে কেন্দ্র করেই শহর গড়ে উঠেছে। সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে কিন্তু নদীর অবদান বেশি। যেমন মিসরকে নীল নদের দান বলা হয়। ‘ও নদী রে...’ এই কথা এখন আর বলা যায় না, বলতে হয়, ‘আহা, নদী রে!’ দূষণ আর দখলে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের প্রায় সব নদী। বিশেষ করে রাজধানী বা বড় শহরগুলোর নদীগুলোর অবস্থা শোচনীয়। আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই।

অনেক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের ভয়ে সাক্ষ্য দেন না কেউ। বলা যায়, জনগণের সহায়তা নেই। এ কারণে রূপসা থেকে সুরমা, নাফ-হালদা-পুনর্ভবা, করতোয়া থেকে তিতাস-কর্ণফুলী সবই দূষণ আর দখলের শিকার। আর রাজধানীকেন্দ্রিক নদীগুলো তো এক একটা বিষফোঁড়া হয়ে গেছে।

বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-তুরাগের পানি বিষাক্ত, লালচে কালো হয়ে গেছে। অথচ নদীগুলো দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন খাতকে বিকশিত করতে পারত। এখনো ব্যবস্থা নিলে পর্যটন খাতকে বিকশিত করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রেহাই দেবে। এজন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সময়োপযোগী আইন-বিধিমালা প্রণয়ন করে এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। বিবিসির এক সমীক্ষায় দেখা যে, বাংলাদেশের ৪৩৫টি নদী এখন হুমকির মধ্যে। এর মধ্য ৫০ থেকে ৮০টি নদী বিপন্ন।

এখন এ সংখ্যা অনেক বেশি। তবে আশার কথা সরকার কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। জাতীয় নদী কমিশনের এক জেলা সভায় চেয়ারম্যান/সদস্য মারফত এ তথ্য জেনেছি। সরকার কিছু কাজও শুরু করেছে। দূষণ ও নদীর ব্যাপারে আদালত থেকে নির্দেশনাও রয়েছে। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের রায়ে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর অপমৃত্যু রোধ করে ঢাকা মহানগরকে রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নদী তীরে অবৈধ স্থাপনা অপসারণের পাশাপাশি জরিপ কাজের পর সীমানা নির্ধারণ করে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার নির্দেশও ছিল। কিন্তু সবক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত/কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী এখন যথেষ্ট সজাগ। তিনি প্রকাশ্যে এর ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্যও দিচ্ছেন।

১৯৭৫ সালে এ দেশে নৌপথ ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার, এখন তা মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। শুকনো মৌসুমে এই পথ আরও কমে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারে এসে থামে। দূষণ আর ভরাটের কারণে বদলে যাচ্ছে নদীর চেহারা। অবৈধ দখল আর অপরিকল্পিত নদী শাসনের ফলে ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে নদী, হারাচ্ছে নাব্য।

অপরিকল্পিত ড্রেজিং বা একেবারেই ড্রেজিং না করা, আর ইচ্ছেমতো যেখানে-সেখানে বাঁধ নির্মাণের কারণে নদী মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কপোতাক্ষ, ইছামতী, ভৈরব, মুক্তেশ্বরী, বেতনা, নরসুন্দা, ফুলেশ্বরী, ধনু, রূপসা, ডাকি, শিবসাসহ আরও কত নদ-নদী পরিণত হয়েছে সরু খালে! এমনকি অপরিকল্পিত রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণের কারণেও নদী ভরাট হয়। মূলত দীর্ঘ সময় অবহেলার কারণেই এ দেশে নদীমৃত্যুর হার বাড়ছে।

কোনো-কোনোটির অবস্থা এত খারাপ যে, চেষ্টা করেও নাব্য ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদী শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা প্রায় একই দশায় পড়েছে। এগুলোতে পানির চেয়ে বর্জ্যই বেশি। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে এ নদীগুলো পানি ও রং হারিয়ে ফেলেছে। বর্জ্যরে মিশ্রণে নদীগুলোর পানি কালো, নীল বা লাল হয়ে গেছে। সরকার এ চার নদীকে ‘প্রতিবেশ সংকটাপন্ন’ ঘোষণা করেছে। আর বিশ্বব্যাংক বুড়িগঙ্গাকে অভিহিত করেছে ‘মরা নদী’ নামে।

চামড়া শিল্পের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীকে দূষিত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও ঢাকার পাশের নদীগুলো এতটাই দূষিত যে, এসব নদীর পানি এখন শোধনেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীগুলোতে এক সময় প্রচুর মাছ ছিল। অথচ এখন শুধু মাছ নয়, কোনো জলজপ্রাণিই টিকে থাকতে পারছে না। বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ঢাকা নগরীতে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ঘনমিটারেরও বেশি পয়োবর্জ্যরে প্রায় সবটাই উন্মুক্ত খাল, নদী, নর্দমা বেয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় এসে পড়ছে। টঙ্গী, বাড্ডা প্রভৃতি অঞ্চলের বর্জ্য চলে যাচ্ছে বালু ও তুরাগে। বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে আরও। শুধু সায়েদাবাদের শোধনাগারে কাজ হবে না।

বিআইডব্লিউটিএর মতে, ১৯৭১ সালে এ দেশে নদী ছিল ২৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা ১৯৮৪ সালে কমে দাঁড়ায় আট হাজার ৪০০ কিলোমিটার। আর বর্তমানে আমরা হারিয়েছি মোট ১৮ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ। অবশিষ্ট আছে মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার। গবেষকরা মতপ্রকাশ করেছেন, এ অবস্থা চলমান থাকলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ নদীমাতৃক বাংলাদেশ শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে, বাস্তবে থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার চার নদীর দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠান ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ছাড়াই পরিচালনা চালাচ্ছে। ফলে তার দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি পড়ছে নদীতে। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতর থেকে বারবার অভিযান চালিয়েও দূষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযান চালিয়ে নদীদূষণের জন্য দায়ী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জরিমানাও করা হচ্ছে। পরিবেশ আইনে মামলা করা হলেও ওইসব মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে- এমন নজির নেই। আর এ কারণেই শুধু জরিমানা দিয়ে তারা আবার শুরু করছে দূষণের কাজ। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শহরগুলোয় পরিবেশ দূষণের কারণে বছরে ৬৫০ কোটি ডলারের (৫৪ হাজার কোটি টাকা) ক্ষতি হয়, যা ২০১৫ সালের জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। শহরের পরিবেশ দূষণজনিত কারণে বছরে ৮০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়, যা মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশ।

অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ এর কয়েকগুণ বেশি। Enhancing opportunity for clean & resilient growth in urban Bangladesh প্রতিবেদনে শহরগুলোয় মানুষের জীবনমানের ক্ষতির কথাই শুধু বলা হয়েছে। দেখা গেছে, ঢাকা নগরীর নদ-নদীগুলোর দূষণের কারণে ঢাকা ও এর আশপাশের কয়েকটি জেলায় আমরা বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি মাছ থেকে বঞ্চিত হই।

শিল্প, গৃহস্থালী, পয়োবর্জ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। নদী রক্ষায় পরিকল্পনা, প্রতিবেদনের কমতি নেই। অভাব শুধু দূষণকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা, দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণের। আইনের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ঢাকায় প্রতিদিন চার হাজার ২০০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে সিটি করপোরেশন মাত্র ৪৫ শতাংশ সংগ্রহ করে। বাকিটা উন্মুক্ত জায়গায়, নিম্নাঞ্চলে পড়ে থাকে। শেষ গন্তব্য নদী।

বর্জ্য নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট কনসার্নের হিসেবে, ১০ বছর পর এই বর্জ্যরে পরিমাণ হবে সাড়ে আট হাজার টন। প্রায় অনুচ্চারিত থাকা আরেকটি দূষণের এলাকা হলো ঢাকা সদরঘাট। সদরঘাটের দায়িত্বে থাকা অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্র হতে জানা যায়, সদরঘাট হয়ে থেকে প্রতিদিন ৪০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এই মানুষদের বর্জ্য ও ৩০টি নৌযান ধোঁয়ার পর তেলসহ নানা বর্জ্য পড়ে নদীর পানিতে।

নদী বাঁচালে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনাময় খাত জেগে উঠবে। যোগাযোগ, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য খাত সরাসরি উপকৃত হবে। আর পরোক্ষভাবে অনেক খাতে অক্সিজেন সরবরাহ হবে। জেলে ও কয়েকটি সম্প্রদায়ের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি ক্ষুদ্র/মাঝারি কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হবে।

আবু আফজাল সালেহ
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
[email protected]

 
Electronic Paper