উড়ছে ঈগল বিশ্বজুড়ে
অর্ঘ্য মান্না ও আবাহন দত্ত
🕐 ৯:৩২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০১৮
১ জুন, ২০০২। জাপানের সাপোরো শহর। যা হওয়ার ছিল, হলো তা-ই। জার্মান বাহিনীর কাছে ৮-০ গোলে চূর্ণ হলো সৌদি আরব। তবে এই হারকে তত ‘লজ্জাকর’ বলবেন না কেউ। এ-ই তো ভবিতব্য। ১৬ বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপের পরে বলাই যায়, আজ আর ভবিতব্য এমন নয়।
আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া ০-৩, জার্মানি-মেক্সিকো ০-১, পর্তুগাল-ইরান ১-১ পরিসংখ্যানই বলছে গড়ে উঠছে নয়া ফুটবল-সংস্কৃতি। স্কিল আর ঐতিহ্যের মিশেলে যে আভিজাত্য, তা কি তবে ধসে পড়ছে?
তর্কটা ত্রিস্তরীয়। প্রথম স্তরটি একমুখী। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে নতুন জীবনের খোঁজে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সেই ঢল এখন এতই বেশি যে জার্মানি, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ডের মতো ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে অভিবাসী মানুষের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে ১০ ছাড়িয়ে গিয়েছে। নতুন দেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়া চিরদিনই খুব কঠিন। গরিব দেশ থেকে গেলে কাঠিন্য আরও কিছু বেশি। ফলে সমাজের ‘নিচু’ থেকে ‘উঁচু’-তলায় উত্তীর্ণ হতে গেলে কিছু আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। যেমন, শিক্ষা। কিংবা সমাজসেবা। তবে এ জাতীয় সুযোগ নেই সবার। অগত্যা ফুটবল।
দ্বিতীয় স্তরটি দ্বিমুখী। প্রভুরাও অনেক সময় পদানত হন ‘ছোট’ দেশের কাছে। ফুটবলে। বোয়েতাং ভাইদের গল্পটা পরিচিত। শরণার্থী হয়ে ঘানা থেকে জার্মানিতে চলে এসেছিল কেভিন আর জেরোম বোয়েতাংয়ের আগের প্রজন্ম। জার্মানিতে কেভিন খেলতেন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে।
তার পর অনূর্ধ্ব-২১ দলের জার্সি গায়ে জার্মানিকে ইউরো কাপ চ্যাম্পিয়নও করেন। সে সময় তার সতীর্থ ছিলেন মেসুত ওজিল, ম্যানুয়েল নয়্যার, সামি খেদিরা, মাটস হুমেলস। জার্মান ফুটবলের সোনার সময়। কিন্তু শিবির চলাকালে নাইটক্লাবে যাওয়ায় সাসপেন্ড করা হয় কেভিনকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘানা ফিরে গিয়ে সে দেশের জাতীয় দলে যোগ দেন তিনি। জেরোম থেকে যান জার্মানিতেই। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে মুখোমুখি হয় দুই ভাইয়ের দেশ, জার্মানি আর ঘানা। চমকের নাম ফুটবল।
স্ট্রাইকার সামান ঘোদ্দোসের বাবা-মা ইরান থেকে অভিবাসন করেছিলেন সুইডেনে। ২০১৭-য় তিনি সুইডিশ দলে যোগ দেওয়ার পর খবর পৌঁছায় তেহরানে। ‘স্বদেশ’ থেকে ডাক পড়ে ঘোদ্দোসের। সাড়া দেন তিনি। রাশিয়ায় বিশ্বকাপের মঞ্চে পা রাখেন ইরানের জার্সি গায়ে। এমন মিলমিশ অবশ্য অনেকেরই না-পছন্দ। বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি ফুটবলার লরাঁ ব্লাঁ-র মন্তব্য : ‘দেশের ফুটবল একাডেমিগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশি ফুটবলারের সংখ্যা ৩০ শতাংশে বেঁধে দেওয়া উচিত। এতেই সুরক্ষিত থাকবে আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। ১২-১৩ বছর বয়স থেকে এই সংরক্ষণ চালু করা উচিত। এভাবেই জাতীয় দলে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কমাতে পারব আমরা।’ বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের দায়ে দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তবে এটা যে অনেকেরই মনের কথা, মালুম হয় রোমেলুর উক্তিতে : ‘আমি ভালো খেললে ওরা বলেন, বেলজিয়ামের স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। কোনো দিন ভালো খেলতে না পারলে ওরা বলেন, কঙ্গো-বংশোদ্ভূত স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু।’ কিন্তু ফুটবলারের দেশ ও ভাবে নির্ধারণ করা যায় না। ঘোদ্দোসের মন্তব্য, ‘আমার শোওয়ার ঘরে দুটি জাতীয় পতাকা টাঙানো থাকে। একটি সুইডেনের, অন্যটি ইরানের। আমার কাছে এটা ক্লাব পছন্দ করার মতো, তার বেশি কিছু নয়।’
এবারের বিশ্বকাপে সুইস ফুটবলার গ্রানিত জাকা আর জরেদান শাচিরিকে নিয়ে খুব হইচই হয়েছে। শাচিরির জন্ম কসোভোয়। ২০০৮ সালে তা সার্বিয়ার থেকে স্বাধীন হয়ে গেলেও সার্বরা সেটা স্বীকার করেন না। কসোভোর স্বাধীনতার পক্ষে কথায় বলায় তার বাবাকে সাড়ে তিন বছর বন্দি থাকতে হয়েছিল তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ায়।
জাকার বাবা-মা আলবনীয় বংশোদ্ভূত, ভাই আলবানিয়ার জাতীয় দলের ফুটবলার। ১৯৯৮-৯৯ যুদ্ধের পরে এই দুই পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল সুইজারল্যান্ডে। গোল করার পর তাই আলবানিয়ার জাতীয় প্রতীক ঈগলের মতো ভঙ্গি করেছিলেন তারা। ফিফার শাস্তির কোপে পড়লেও বার্তাটি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া গিয়েছিল। অগণিত ফুটবল-ভক্ত ঈগলকে প্রতিবাদের প্রতীকেই গ্রহণ করেছেন।
এই ঈগলরাই ফুটবলের ভবিষ্যৎ। অফুরান প্রাণশক্তিতে তারা ভেঙে দিচ্ছেন ফুটবল দুনিয়ার একচেটিয়া আধিপত্য, জিতে নিচ্ছেন মাঠের লড়াই আর দর্শকদের মন। ঈগল সীমানা জানে না, সীমানা মানে না। বিশ্বকাপ তাই, শেষ পর্যন্ত, ঈগলদেরই।
অর্ঘ্য মান্না ও আবাহন দত্ত : ভারতীয় সাংবাদিক।