ক্রীতদাসের নবরূপ ‘কাফালা’
আবু আফজাল সালেহ
🕐 ১০:০৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯
শ্রমিক নিগ্রহের কালো প্রথা হচ্ছে ‘কাফালা’। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে প্রচলিত এ অমানবিক প্রথাটি অভিবাসীদের অধিকার খর্ব করছে। দেখা যাবে, বাংলাদেশ বা যেকোনো এক বা দুটো দেশ প্রতিবাদ করতে চাইলে সে দেশ থেকে শ্রমিক না নিয়ে বিকল্প দেশ থেকে শ্রমিক নেবে তারা। তাদের শ্রমিক লাগবেই। তাই মধ্যপ্রাচ্যে যেসব দেশ শ্রমিক পাঠায় সেসব দেশকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
কাফালার শর্তই এমন, গৃহকর্তার অনুমতি ব্যতীত কোনো গৃহকর্মী বা শ্রমিক গৃহত্যাগ করতে পারবে না। অন্যস্থানে কাজ করতে পারবে না। এমনকি গৃহকর্তার অনুমতি ছাড়া কোনো গৃহকর্মী নিজ দেশেও ফিরতে পারবে না। চরম অমানবিক দিকটি হচ্ছে গৃহকর্মীর পাসপোর্ট ও ভিসার কাগজপত্র গৃহকর্তা নিজের কাছে রেখে দেন। এ প্রথা পরিবর্তন করা দরকার।
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) অন্তর্ভুক্ত ছয়টি দেশে (সৌদি আরব, বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান) প্রচলিত ‘কাফালা পদ্ধতি’ অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ ও বঞ্চনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ‘কাফালা’ পদ্ধতিতে বিদেশি শ্রমিকদের জিসিসিভুক্ত দেশের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের (স্পন্সর) সঙ্গে যুক্ত করা হয়। আইনানুগভাবে একমাত্র সেই স্পন্সরই তার নিয়োগকারী। এই নিয়োগকারীর অনুমোদন ছাড়া কোনো শ্রমিকের পেশা বা কর্মস্থল পরিবর্তনের অধিকার থাকে না।
কর্মস্থলে শ্রমিকের বেতন আটকে রাখা, চাহিদামতো খাবার না দেওয়া, শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা আমরা মিডিয়াতে দেখতে পাই। কিন্তু বেশির ভাগ নির্যাতনের খবর আলোয় আসে না। এর ফলে, প্রবাসীরা আমাদের যে হারে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দেন, তার মূল্যায়ন হচ্ছে না। শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা-পত্রিকার কাছে প্রতিদিন দেড়-দুশোর বেশি অভিযোগ আসে বলে ধারণা করা হয়। এর বেশির ভাগই ঘটে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে।
শুধু বাংলাদেশি মেয়ে নয়, এশিয়া এবং আফ্রিকার আরও অনেক দেশ থেকে গৃহকর্মীর কাজ করতে মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্যে যায়। কাফালা নিয়মে অভিবাসী শ্রমিকদের ভিসা দেওয়া হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই (বিশেষ করে সৌদিআরবের গৃহকর্তাদের অনেকাংশ) গৃহকর্মীকে কিনে নিয়েছে মনে করে আচরণ করে। অবাধ্য হলে শাস্তি পেতে হবে। ঘর থেকে পালালে তাদের গ্রেফতার করা হবে, জেলে দেওয়া হবে। অমানুষিক কাজের ভারে, অনাহারে, অত্যাচারে, অবিচারে, অতিষ্ঠ হয়ে গৃহকর্মীরা পালাতে চায়। কেউ পালাতে পারে। কেউ কেউ পালাতে পারে না। তাই তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করে।
শাস্তির মধ্যে নারী শ্রমিকের ওপর শারীরিক নির্যাতন। ধর্ষণই প্রধান শাস্তি বলে অনেকে মনে করে। অনেক নারী শ্রমিককে বাবা-ছেলে উভয়ই ধর্ষণ করে বলেও জানা যায়। শুধু সৌদি আরবে নয়, জর্দান, লেবানন, ওমান, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতেও গৃহকর্মীদের ওপর শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতন চলে।
গৃহকর্মীদের ভিসা দিয়ে নিয়ে আসবে নিজের দেশে, তারপর থেকে গৃহকর্মীটি তার অধীনে। সে তখন তার সম্পত্তি, তার ক্রীতদাসী। স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকবে না সেই গৃহকর্মীর। এই শ্রমিকের পক্ষে কোনো আইন নেই। আইন গৃহকর্তার পক্ষে। গৃহকর্তা পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাসীকে শাস্তি দিতে চাইলে গৃহকর্তার পক্ষের আইন তাকে শাস্তি দেবে। সে কারণেই মেয়েরা জেল খাটে। সে কারণেই গৃহকর্মী নামক ক্রীতদাসীরা নির্যাতিত হলেও সে দেশের আইন তাদের পক্ষে দাঁড়ায় না। কাফালার শর্ত ভাঙলেই শ্রমিকদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশ থেকে।
প্রমাণিত যে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইনের কিছুই আরবেরা মানে না। সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক দেশে ফিরছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসছে শত শত নারীকর্মী। এশিয়া আর আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। একটি দুটি দেশ প্রতিবাদ করলে কোনো লাভ নেই। সব দেশকে রুখে দাঁড়াতে হবে। নারী-শ্রমিকদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করা হলে, নারী-শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন সম্পূর্ণ বন্ধ বা প্রাপ্য বেতন নিয়মিত না দিলে, ক্রীতদাসী ভাবা বন্ধ না করা হলে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন না মানা হলে সংশ্লিষ্ট দেশে আর নারী-শ্রমিক পাঠাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতিত নারীদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েও দেশে ফিরছেন। জানা যায়, প্রবাসী নারীরা এসব বিষয়ে নানা অভিযোগ করলেও এগুলোর নি®পত্তির সংখ্যাও হতাশাজনক। বিদেশের মাটিতে অসংখ্য নারীকর্মী কাজ করলেও তাদের সমস্যা এবং সহযোগিতার জন্য তেমন নেই কোনো শেল্টার হোম, দ্রুত সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নেই হটলাইন। অনেক দেশেই নারীকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেন না। কিছু ক্ষেত্রে নারীরা তাদের হেনস্তার কথা বলে না। লেবার উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তা কম থাকায় এমনটা হয়ে থাকতে পারে। ওমানের অনেক বাড়িতে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এক প্রতিবেদনে জানায়।
বাংলাদেশি নারীকর্মীদের পূর্ণ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কূটনীতি শক্তিশালী নয় বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছেন। জিরো মাইগ্রেশনে নারী শ্রমিকরা এখন বিদেশ যেতে পারছেন। কিন্তু জিরো মাইগ্রেশনে নারী শ্রমিক পাঠানো সর্বমহলে প্রশংসিত হলেও প্রত্যেক নারীকর্মী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দালালি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দালালের মাধ্যমে নারীকর্মী সংগ্রহ করার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী পাঠানোর সার্ভিস চার্জের প্রাপ্ত অর্থ থেকে উল্লিখিত অর্থ দালালকে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিপরীতে বিদেশে অবস্থানরত নারী শ্রমিকদের অধিকাংশই যৌন হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে নারী নির্যাতনের হার অনেক বেশি।
কাফালা ব্যবস্থার অস্তিত্ব এবং তার অপব্যবহার সারা বিশ্বের জন্য এক লজ্জাজনক উদাহরণ। ব্যক্তি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রায়শই পূর্বনির্ধারিত কাজের চুক্তিপত্র ছিঁড়ে ফেলে কম মজুরির কাজ করতে অভিবাসী শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, কাতার এ কালোপ্রথা রোধ করতে এগিয়ে এসেছে।
কাতারের সংশোধিত শ্রম-আইনে সরকার নির্ধারিত একটি পৃথক দপ্তর কর্মসংস্থান চুক্তির শর্তসমূহ পর্যালোচনা করে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে বলে জানা যায়। একই সঙ্গে, কোনো শ্রমিক দেশটি ত্যাগ করে ফেরত যেতে চাইলে মালিকপক্ষ আর বাধা দিতে পারবে না। সব শ্রমিকের জন্য প্রযোজ্য, এমন একটি ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেবে কাতার সরকার।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাতারের এ সিদ্ধান্ত তাদের দেশে বাস্তবায়ন করা দরকার। বিশেষ করে এ ব্যাপারে সবচেয়ে হিংস্র সৌদি আরবকে বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে নতি স্বীকার করাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের শ্রম আইন সংশোধনের যে অঙ্গীকার করেছে, তা যেন মুখের কথা হিসেবেই না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আবু আফজাল সালেহ
উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি), লালমনিরহাট
[email protected]