ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পার্বত্য শান্তিচুক্তি শেখ হাসিনার কীর্তি

মিল্টন বিশ্বাস
🕐 ৮:৫৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০২, ২০১৯

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অন্বেষায় পাহাড়ে বসবাসকারী পাহাড়ি ও বাঙালি সবাইকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। পাহাড়ে শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।

উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন সম্ভব। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সব মানুষই শান্তি চায়। শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। দুই দশক স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চাকা বন্ধ ছিল। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পার্বত্য এলাকা তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়।

বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন হিসেবে গণ্য হয়। শেখ হাসিনা ইউনেস্কো পুরস্কার পান মূলত পার্বত্য শান্তিচুক্তির কারণেই। এটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। চুক্তির পরে পুরো পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হয়।

গত ২২ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সব নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সরকার। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষ আজ জানতে পেরেছে শান্তি, গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও অবদানের কথা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই পার্বত্য এলাকার মানুষ চেয়েছিল নিজেদের স্বায়ত্তশাসন, ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু তাদের সে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনার পরে সে কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। ২১ বছর পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে পার্বত্য এলাকার মানুষের কথা, তাদের জীবনের সুখ শান্তি ও নিরাপত্তার কথা ভেবে, দেশের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করতেই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরে শেখ হাসিনা সরকার তিন বছর আট মাস ক্ষমতায় থাকাকালে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও ভূমি টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীনের পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। বর্তমান মেয়াদে জুম চাষ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, মহাজনি কারবার ও পর্যটন- এ পাঁচটি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে।

রাঙ্গামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন হয়েছে। প্রায় ৫০০টি স্কুল-কলেজ, পাঁচটি স্টেডিয়াম, ২৫টি হাসপাতাল করা হয়েছে পার্বত্য এলাকায়। শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন করা হয়েছে অনেক অঞ্চলে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকেই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পার্বত্য ভূমি কমিশন গঠন করা হয়। ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এ পর্যন্ত পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, এতে ভূমি-সমস্যার সমাধান হয়।

১৯৯৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়েছে কমিশনে, ভূমি-বিরোধ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এখন প্রায় সব আবেদন ফয়সালা করা হয়।

উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নসমূহ পার্বত্য এলাকায় সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে; নির্মাণ কাজ চলছে আরও কয়েকশ কিলোমিটারের।

শান্তিচুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য নিষ্পন্ন তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। কারণ বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ২২টি।

এর মধ্যে সাতটি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আবার তিনজন মহিলা আসন রাখা রয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা রয়েছে।

মূলত পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি বাংলাদেশের মানুষেরই শান্তি। এই বৃহত্তর চিন্তা মাথায় রেখেই কাজ করছে শেখ হাসিনার সরকার। গত ২২ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং বাকিগুলোর বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। বান্দরবান জেলা সদরে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীভিত্তিক ২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে প্রায় ১৪০০ উপজাতি শিশু ও ছাত্রছাত্রী শান্তিপূর্ণভাবে অধ্যয়ন করে যাচ্ছে।

রাঙ্গামাটি শহরে রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট নামে একটি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র চালু রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে চলছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিজস্ব ধর্মীয় উপাসনালয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা প্রদান করে থাকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অতীতের মতো ২০১৯ সালেও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের কারণে তিন পার্বত্য জেলার উপজাতি ও অ-উপজাতিদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করে যাচ্ছে উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নে। এতে করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর তুলনায় উপজাতি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়ন ঘটেছে অনেক বেশি।

এমতাবস্থায়, পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সর্বোপরি শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে উপজাতি-বাঙালি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। তাহলেই কেবল দ্রুত শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আশা করা যায়। তবে সবাই এক কথায় স্বীকার করবেন যে, পার্বত্য শান্তিচুক্তি শেখ হাসিনার অমর কীর্তি।

মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক। জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা
দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper