ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পাবনার নাজিরপুরে গণহত্যা

আবদুল জব্বার
🕐 ৯:৫২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৩০, ২০১৯

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বীর বাঙালি জাতি যখন বিজয়ের দারপ্রান্তে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশলের কাছে নভেম্বর মাসে পাবনা সদর উপজেলার দাপুনিয়া ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে অবস্থানকারী পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থি হটকারী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা পাকিস্তানি শত্রু সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের নাজিরপুর গ্রামে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা চালায়।

পাকিস্তানি শত্রুসেনা ও নকশালরা এদিন ফজরের আজানের পর হেমায়েতপুর ইউনিয়নের চকচিরট গ্রামের মধ্য দিয়ে নাজিরপুর গ্রামে যায়। তারা নাজিরপুর গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তসহ পুরো গ্রামকে ঘিরে ফেলে।

ঘুম থেকে জেগে উঠে যাঁরা প্রাণ বাঁচাতে গ্রামের পশ্চিমে দাপুনিয়ার দিকে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই শত্রুসেনা ও নকশালদের হাতে ধরা পড়েছিলেন, তাদের সবাইকে এদিন হত্যা করা হয়েছিল। যারা পূর্বমুখে হেমায়েতপুর গ্রামের দিকে গিয়েছিলেন তারা সবাই বেঁচে গিয়েছিলেন। নাজিরপুর গ্রামের হেজাজের দহ নামক স্থানে মকবুল মাস্টারের বাড়ির কাছে এবং শুকলালের বাড়ির পাশে গর্তের মধ্যে পাকিস্তানি শত্রুসেনারা নকশালদের সহায়তায় ৬৬ জনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে। শুকলালের বাড়ির পাশে যে স্থানটির গর্তের মধ্যে পাকিস্তানি শত্রুসেনারা গণহত্যা চালিয়েছিল সেই স্থানটি এখন প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে নাজিরপুরসহ পশ্চিমাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নজরুল ইসলাম (হাবু)র নামে স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের চত্বরের মধ্যে পাবনা-রূপপুর সড়কের পাশে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এ পর্যন্ত ৭১’র স্মৃতি বিজরিত গণহত্যার স্থানটিতে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। পাবনা শহর থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরবর্তী নাজিরপুর গ্রামটি দেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ গ্রামের নারী-পুরুষরা রাত জেগে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন, পাহারা দিতেন এবং শেল্টার দিয়ে সব রকম সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন।

আর এ অপরাধের কারণে এ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী-পুরুষসহ সাধারণ নিরীহ গ্রামবাসীকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে এ গ্রামের নারী পুরুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা কোনো দিন ভুলার নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত নাজিরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করার কারণে আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।

পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুর, দাপুনিয়া এবং মালিগাছা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নাকশালদের সঙ্গে অসংখ্য খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা, যারা এসব যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছেন, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর নাজিরপুর গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ যেসব মুক্তিকামী মানুষ গণহত্যায় শাহাদতবরণ করেছিলেন তাদের ৪০ জন নাজিরপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং অবশিষ্ট ২৬ জন নাজিরপুর গ্রামের আত্মীয়।

যারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে নাজিরপুর গ্রামকে নিরাপদ মনে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে এসে অবস্থান করেছিলেন এ দিন লোমহর্ষক গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানি শত্রুসেনা ও নকশালরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে গ্রামবাসী বিকালে তাড়াহুড়া করে শহীদ স্বজনদের নামাজে জানাজা শেষে নিজ নিজ বাড়ির সামনে দাফন করেছিলেন।

এ দিন শত্রুসেনা ও নকশালদের কবল থেকে কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আমার ছোট মামা আবদুল হামিদ প্রাং। তিনি ওই দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন পাবনা সদর উপজেলার মালঞ্চি ইউনিয়নের কাশিনাথপুর গ্রামে। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আমরা যারা ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম তারা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাবনা জেলার পাবনা সদর উপজেলার নিরাপদ গ্রামগুলোতে অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। ওই দিন সকালবেলাতেই আমরা নাজিরপুর গ্রামে গণহত্যার সংবাদ পেয়েছিলাম।

সন্ধ্যার পর আমার মামা হামিদ প্রাং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জেদ ধরে বলেন, আমি বাড়িতে যাব। তাকে বার বার অনুরোধ করেও তার সিদ্ধান্ত বদলাতে পারিনি। বাধ্য হয়েই থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে নিয়ে রাতের বেলা মামার সঙ্গে নাজিরপুর গ্রামে রওনা হলাম।

মামার হাতে ছিল খেজুর গাছ ঝোড়ার ধারালো ছেনদা। রাত ৮টার দিকে আমি ও মামা নাজিরপুর গ্রামে গিয়েছিলাম। মামা তার বাড়ি সংলগ্ন উলুক্ষেতের মধ্যে যেখানে তার লাইসেন্সকৃত একনলা বন্দুক রেখেছিলেন সেখোনে যান। বন্দুকটি না পেয়ে মামার মন দুর্বল হয়ে পড়ে, এ সময় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সারা গ্রাম নীরব-নিস্তব্ধ। এত বড় গণহত্যা হয়েছে তবুও গ্রামের কোনো বাড়িতে কান্নার শব্দ নেই। মামা বিল পাড়ার লোকমান সরদারের বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে লোকমান সরদারের নাম ধরে ডাকলেন। মামার ডাক শুনে বাড়ির মধ্য থেকে কয়েকজন মহিলা ও শিশু গেটের সামনে এলেন কিন্তু তারা কেউ কিছু বললেন না। সবাই স্বজন হারানোর বেদনায় শোকাহত।

আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না শত্রু সেনারা এদিন লোকমান সরদারকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। রাতে নাজিরপুর গ্রামজুড়ে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করে, সবার ধারণা রাতের বেলা নাজিরপুর গ্রামে পুনরায় আক্রমণ হতে পারে এই আশঙ্কায়। এ দিন রাতের বেলা কোনো বয়স্ক পুরুষ মানুষ নাজিরপুর গ্রামে ছিল না। এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে মামা আমাকে বিলপাড়ার মাঠের মধ্যে রেখে গেলেন নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য।

ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত। মাঠের মধ্যে দেখতে পেলাম অগণিত মানুষ। তারা সবাই খেসারি ক্ষেতের মধ্য থেকে উঁকি মেরে এদিক ওদিক দেখছেন। নাজিরপুর গ্রামের অনেক বাড়ির সামনেই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী এসব শহীদের বাঁধানো কবর আজো মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছে।

এদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা হলেন-শহীদ জোনাব আলী সরদার, লোকমান সরদার, রুব্বেল সরদার, মোয়াজ্জেম হোসেন, চাঁদ আলী প্রাং (পঁচা), পাঞ্জাব আলী, খইরুদ্দিন প্রাং, কুলমদ্দিন প্রাং, আব্বাস আলী, খোরশেদ আলী, খইরুদ্দিন প্রাং, মালু প্রাং, আব্বাস আলী, খোরশেদ আলী, সাকুব্বর আলী সরকার, আমিন উদ্দিন, ময়েজ উদ্দিন, ডা. ছামেদ প্রাং, আনতাজ প্রাং, ইজ্জত প্রাং, বান্ডুল প্রাং, আসলাম প্রাং, টিপু প্রাং, আজগর প্রাং, কুশাই প্রাং, আহম্মদ আলী প্রাং, ছোহরাব আলী প্রাং এবং হিরাই প্রাং (সহোদর তিন ভাই), ইউনুস আলী প্রাং, রাংতা, মোক্তার হোসেন প্রাং, মিরজান, আজারি প্রাং, মোতালেব সরদার, আজাহার প্রাং, নাজিরপুর বিশ্বাস পাড়ার রহমত বিশ্বাস, শাহজাহান আলী, সেকেন্দার আলী, সলিম প্রাং, মজিবর প্রাং, জবাঠসা (দাপুনিয়া ইউনিয়নের দুর্গারামপুর গ্রামের বাসিন্দা), আকাই প্রাং এবং মোসা প্রাং। অবশিষ্ট ২৬ জনের নাম জানা সম্ভব হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য, নাজিরপুর গ্রামের এই দিনে যারা গণহত্যায় নিহত হয়েছিলেন তাদের পরিবারকে অদ্যাবধি শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।

এ ছাড়াও একটি স্বার্থান্বেষী মহল থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নারী-পুরুষের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী এ গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে মিথ্যা অভিযোগে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করা হচ্ছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও গেজেট প্রকাশ নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা, যাদের নাম লাল বার্তা, মুক্তিবার্তা এবং প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত গেজেট ও সনদ আছে তাদেরও নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির পরীক্ষার জন্য সম্মুখীন হতে হচ্ছে। লাল বার্তা, মুক্তিবার্তায় যে সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যারা নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত ভাতা পেয়ে আসছেন।

বিজ্ঞজনদের ধারণা, কোনো সুযোগসন্ধানী মহল নেপথ্যে থেকে সুপরিকল্পিতভাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণ্ন করার জন্য এ কাজগুলো করছে। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধারা যত দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন সেটাই হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক।

বর্তমান তরুণ সমাজ মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো বিভেদ ও বিভ্রান্তি দেখতে চান না। কারণ বিষয়টি যেমন অনাকাক্সিক্ষত তেমনি লজ্জাজনকও বটে। বর্তমান সরকার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশের মধ্যে ঘটে যাওয়া বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন।

পাবনার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, মাধপুর ও মালিগাছা রণাঙ্গনসহ এ সমস্ত রণাঙ্গনের স্থানগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, নাজিরপুর গণহত্যার স্থানটি সংরক্ষণ করে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণসহ যে সমস্ত স্থানগুলো মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বীরত্বের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে সেগুলো চিহ্নিত করে মুক্তিযুদ্ধ সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

আবদুল জব্বার : বীর মুক্তিযোদ্ধা
ও মানবাধিকার কর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper