ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আবাসিকে শব্দদূষণ বন্ধ করুন

নূরুজ্জামান
🕐 ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০১৯

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের খেতাব পেয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। তাই দেশের উচ্চ আদালত ঢাকার আশপাশের ইটভাটাগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু শব্দদূষণের অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে পড়া নগরবাসীকে মুক্তি দেবে কে? বিভিন্ন মাত্রার ও ধরনের শব্দদূষণ নগরবাসীকে অসুস্থ করে চলেছে। বিরক্তিকর শব্দদূষণের কালোহাত এখন আবাসিক এলাকায়ও মানুষের জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দিনের বেলার যানবাহনের বিকট শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা উচ্চ শব্দের গান-বাজনার আজ পর্যন্ত কোনো কূল-কিনারা হয়নি। সেই সঙ্গে নতুনমাত্রা যুক্ত করেছে রাতের শব্দদূষণের বিভীষিকা! গাড়ি চালানোতে যেমন মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মকানুন তেমনি বন্ধ হচ্ছে না বিভিন্ন ধরনের গাড়ির বিকট ও বিচিত্র ধরনের স্বেচ্ছাচারী হর্ণ বাজানো।

তারচেয়েও বড় কথা নগরবাসীর রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর শব্দদূষণ করে ওয়েল্ডিং মেশিনের বিকট শব্দ। এরপর আছে ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা অ্যাম্ব্রডারি ও সেলাই মেশিনের অস্বস্তিকর শব্দ। সেই সঙ্গে চলে এসব কারখানার শ্রমিকদের বাজানো উচ্চশব্দের গান। রাতের বেলা যখন এসব মেশিন চলে তখন আশপাশের ভবনগুলোতে যেন ভূমিকম্প হতে থাকে!

রাস্তা বা বাড়ির ছাদে শামিয়ানা টাঙিয়ে বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে গভীর রাত পর্যন্ত বাজানো হয় বধির করা লাউড স্পিকারে গান। সঙ্গে থাকে নাচের ঝঙ্কার। এর সঙ্গে শীতকালে বাড়তি পাওয়া যায় ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিল। একটি মাহফিলের অনুষ্ঠানই যথেষ্ট কয়েক কিলোমিটার এলাকার মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে হার্ট ও প্রেশারের রোগীদের হাসপাতালে পাঠানোর জন্য।

দেখা যায় ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মূল অনুষ্ঠানস্থল ছাড়িয়ে মহল্লার মোড়ে মোড়ে মাইক টাঙিয়ে তাতে বিকট শব্দ করে চলে বক্তৃতার প্রতিযোগিতা। আর সে বক্তৃতার ধরনও বিচিত্র।

কেউবা মধুর ও মৃদু স্বরে বয়ান করেন, কেউ বা বক্তৃতা দেওয়ার সময় মাঝে মধ্যেই বিকট শব্দে চিৎকার করে ওঠেন! আবার কখনোবা এমনভাবে ধমক দিয়ে ওঠেন যে সেই ধমকে ছোট ছোট শিশুরা ভয়ে চমকে ওঠে। তাদের ধমক আর চিৎকার শুনে মনে হয় কেয়ামত নাজিল করছেন! যখন মধুর ও মৃদুস্বরে বয়ান হয় তখন হয়তো ধর্মভিরু মানুষের কারও কারও ভালো লাগে। কিন্তু ধমকানি ও চিৎকারি বয়ান শোনে হৃদরোগীদের হার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়! আর এই মৌসুমের এসএসসি, এইচএসসিসহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার প্রভাব তো ঘুরে-ফিরে জাতির ঘাড়েই পড়ে!

শিশু, বৃদ্ধ, রোগীসহ কর্মজীবী মানুষের কষ্টের কথা না হয় বাদই দিলাম! পরহেজগার নামাজি মানুষের কষ্টের গভীরতার কথা কে শোনে? তারা তো এশার নামাজের পরপরই ঘুমিয়ে পড়েন,যাতে শেষরাতে জেগে ওঠে সবচেয়ে মূল্যবান তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতে পারেন। অন্যদিকে কর্মজীবী মানুষ অনেকেই কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরেন একটু রাতে। তাদের অনেকেই সারা দিনের কর্মব্যস্ততার করণে কোনোমতে ফরজ সলাতগুলো আদায় করে রাতে একটু নিরিবিলি মনোযোগ দিয়ে এশার সালাত আদায় করেন।

এমন কর্মজীবীদের অনেকেই রাত ৯টা/১০টা/১১টা বা তারও পরে এশার সালাত আদায় করেন। কিন্তু যখন একশ্রেণির মানুষ রাত ১২টা/একটা পর্যন্ত এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়েশাদির অনুষ্ঠানে সারা রাতও লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করেন, ওয়াজ-মাহফিল করেন তখন এসব নামাজির নামাজে মনোনিবেশ করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

যেখানে হাদিসে মহানবী (সা.) সালাতরত মানুষের পাশে উচ্চস্বরে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতেও নিষেধ করেছেন, সেখানে বিয়েশাদি, ওয়াজ-মাহফিলের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে নামাজির নামাজে মনোনিবেশে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা কতটুকু যৌক্তিক? আমার জ্ঞানে এমন বিয়েতে যেমন পাপ হচ্ছে তেমনি এমন ওয়াজেও পাপ কুড়ানো হচ্ছে। আমাদের দেশের আইন কী বলে জানি না। তবে শব্দদূষণ তো নিঃসন্দেহে বেআইনি কাজ। আর পরিবেশ দূষণ কি বেআইনি কাজ নয়? আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তাহলে শিশু, বৃদ্ধ, রোগী, কর্মজীবী মানুষের ঘুমের অধিকার কে দেবে?

আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ার বিশেষ করে পরিবেশ ও শব্দদূষণ করার মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুমোদন দিচ্ছেন কারা? আর যদি না দিয়ে থাকেন তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর কেন বসে বসে আঙ্গুল চুষছেন। মানলাম পরিবেশ অধিদফতরের লোকবল কম কিন্তু শব্দদূষণ বন্ধের জন্য তো পুলিশ প্রশাসনও ব্যবস্থা নিতে পারে।

আর বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো! তাদের লোকজন তো প্রতি মাসেই বিদ্যুতের মিটার দেখতে যান, বিল দিতে যান। তারা কী করেন? তারা কেন পরিবেশ দূষণকারী ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছেন না? শোনা যায় বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুতের বিল নিচ্ছেন! আবার এও শোনা যায়, বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কিছু কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্সও দিয়েছেন! কী করে সম্ভব?

বেশির ভাগ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করার বেআইনি অনুমতি দেওয়ার অধিকার সিটি করপোরেশন বা বিদ্যুৎ বিতরণকারি কোম্পানিগুলো পেল কোথা থেকে? আরেকটি ভয়াবহ পরিবেশ দূষণকারি প্রতিষ্ঠান হলো প্রিন্ট ফ্যাক্টরি। স্কিনপ্রিন্ট ফ্যাক্টরিতে ব্যবহার করা বিভিন্ন ধরনের রঙের দুর্গন্ধের কারণে আশপাশের ভবনগুলোও বসবাসের জন্য অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ছে।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে এভাবে শব্দ ও পরিবেশ দূষণ করে মানুষকে কষ্ট দেওয়া শরিয়ত সম্মত নয়। তাই যেসব ধর্মীয় কার্যক্রম মানুষকে কষ্ট দেয় তা বন্ধ করা ধর্মগুরুদেরও পবিত্র দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ওয়াজ-মাহফিল, বিয়েশাদিসহ যেকোনো ধরনের শব্দদূষণকারি কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

বিয়ের মতো পবিত্র অনুষ্ঠানে গান-বাজনা করা তো অর্থের অপচয় ও শরিয়তের বিধানের পরিপন্থী, যা করে শয়তানের বন্ধু হওয়া ছাড়া কোনো ফায়দা হয় না। আর শয়তান যেহেতু আল্লাহর সবচেয়ে বড় প্রকাশ্য শত্রু, তাই শয়তানের বন্ধু হলে সেও কি আল্লাহর সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত হলো না? অন্যদিকে বিভিন্ন দিবস হিসেবে পালন করা অনুষ্ঠান যেহেতু ইসলাম সমর্থন করে না, সেহেতু সেগুলো করা মানে নিষিদ্ধ কাজে নিকৃষ্ট শয়তানের সহযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।

মোদ্দাকথা, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কোনো আইনই এভাবে শব্দদূষণ করার অনুমদোন দেয় না। তাই সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব আবাসিক এলাকাতে যাতে নির্বিঘেœ নির্ঝঞ্ঝাটে মানুষ বসবাস করতে পারে সে বিষয় নিশ্চিত করা। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিসমূহ, পরিবেশ অধিদফতর ও পুলিশ প্রশাসনের এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা কাম্য।

নূরুজ্জামান : কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper