ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বায়ুদূষণ নিয়ে সচেতনতা বাড়ুক

আবু আফজাল সালেহ
🕐 ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৭, ২০১৯

বায়ুদূষণে আমাদের রাজধানী ঢাকা ভারতের রাজধানী দিল্লিকে সরিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছে। এটা খুবই নেতিবাচক খবর। আগে থেকেই শহর হিসাবে ঢাকা ও দেশ হিসাবে বাংলাদেশ বায়ুদূষণে শীর্ষের দিকেই আছে। কিন্তু সম্প্রতি এক নম্বর স্থান দখল করেছে ঢাকা। গত এক বছর ধরে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় উপরের দিকেই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকা।

দূষিত শহরের তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভারতের দিল্লি, কলকাতা আর পাকিস্তানের লাহোর। তবে শীত মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই দূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এমনকি ভারতের ‘গ্যাস চেম্বার’ আখ্যা পাওয়া দিল্লির বাতাসের চেয়েও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে ঢাকার বাতাস। ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষকরা বলছেন, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আট দিন (দিনের বেশির ভাগ সময়) ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ রাজধানীর সাতটি এলাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহ ধরে ঢাকার মধ্যে বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল কারওয়ান বাজার এলাকায়। এরপরই মোহাম্মদপুর ও গুলশান এলাকা। এর বাইরে উত্তরা, মিরপুর ও নর্দ্দা এলাকার বায়ুর মানও বেশ খারাপ। এলাকাভিত্তিক বায়ুর মানের রকমফের থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর বলে জানান গবেষকরা।

আমরা কয়েকটা কারণ বা দিক নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেব। কিছু উদ্যোগের কথা বলব, কিছু বিকল্প প্রস্তাবনাও থাকবে। কিছু কর্মসূচির কথাও আলোচনায় থাকবে। বায়ুদূষণে প্রধানত দায়ী কয়েকটি ইন্ডিকেটর। ইটভাটা, পুরনো যানবাহন, গণপরিবহনের আধিক্য, সবুজ অংশের হ্রাস ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। অপরিকল্পিত নগরায়ণে অনেক অপরিপক্ব কাজ আসবে। নির্মাণ কাজেও ঢাকার বায়ুদূষণ হচ্ছে। যত্রতত্র আর অসময়ের নির্মাণকাজ ঢাকার বায়ুদূষণ বৃদ্ধি করতে সহায়তা করছে। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে ভবন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ উন্মুক্তভাবে করার ফলে শহরের বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বাড়ছে। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ, ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশে দীর্ঘদিন স্তূপীকরণ ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনের সময় অনিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থাপনার ফলে একটি অংশ রাস্তার ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এসব বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনার ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের ফলে এসব বর্জ্য থেকে বায়ুদূষণের সৃষ্টি করছে।

একটি গবেষণা বলছে, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ দায়ী। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, শুধু ঢাকাতেই এক বছরে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশের শহরাঞ্চলে মারা গেছে ৮০ হাজার। পরিবেশ দূষণের সমন্বিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবনের ওপর।

বাংলাদেশে বায়ু, পানি ও পরিবেশ দূষণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৭ ভাগ। পরিবেশ দূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু, রোগী আর বৃদ্ধরা। শুধু বায়ুদূষণে ক্ষতি হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা শহরের ছয় লাখ মানুষ এখন সীসাদূষণের কবলে। ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদানগুলোর অন্যতম বাতাসে বিদ্যমান পিএম২.৫ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) বা অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মান অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এর সহনীয় মাত্রা ১০ মাইক্রোগ্রাম। যদিও ঢাকার বাতাসে পিএম২.৫-এর মাত্রা এ মানের অনেক উপরে, প্রতি ঘনমিটারে ৯৭ মাইক্রোগ্রামের বেশি। এ হিসেবে ঢাকার বাতাস মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। চব্বিশ ঘণ্টায়ও ইতিবাচক সবুজ সূচকে আসছে না। দুপুরের পর থেকেই ঢাকা বাতাসে বিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এমনকি ছুটির দিনেও সবুজ সংকেতে আসছে না।

ঢাকা শহরের ছয়টি বিদ্যালয়ের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ে ২০১৬ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আরবান ল্যাব। ফলাফলে দেখা যায়, বিদ্যালয়গুলোর ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না। তাদের ফুসফুস ৬৫ থেকে ৮০ শতাংশ কাজ করছে। কয়েক বছর ধরেই ঢাকার বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার ওপর রয়েছে। ক্ষতিকর বস্তুকণার এ উপস্থিতি না কমে উল্টো বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিদদের অভিমত হচ্ছে, বায়ুতে থাকা সীসা মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটা বিষয়। সীসার উপস্থিতির প্রভাবে মানুষ দ্রুত বুড়িয়ে যায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। বিশেষ করে শিশুরা দুর্বল বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠে।

এ ছাড়া বায়ুতে থাকা ক্ষতিকর বস্তুকণা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুস শক্ত হয়ে অক্সিজেন প্রবেশে বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে ক্যান্সারসহ নানা রোগ জন্ম নেয়। বাতাসে সহনীয় মাত্রার অতিরিক্ত অতিসূক্ষ্ম এ বস্তুকণা স্বল্প মেয়াদে মাথাব্যথা, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ নানা ব্যাধির জন্য দায়ী বলে জানান চিকিৎসকরা। এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনিসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন তারা। আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনও বলছে, বছরে সাত লাখ অপরিণত মৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ুদূষণ। বর্তমান বিশ্বে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এটি।

ইট প্রস্তুতের ধরন ও আগে-পরের বিষয়/পদ্ধতি নিয়ে পূর্বের ইট প্রস্তুত আইন-২০১৩ সংশোধন করা হয়েছে। ইটের বিকল্প হিসেবে ব্লক পদ্ধতিকে যাতে প্রমোট করা হয়, আইনের বিভিন্ন ধারায় তা সংযোজন করা হয়েছে। মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির বিকল্প হিসেবে অপোড়ানো পদ্ধতি ব্লকের দিকে যেতে হবে।

অতিসম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০২৫ সাল নাগাদ পোড়ানো ইট থেকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ সরে আসবে। অবশ্য ২৬ নভেম্বর আদালত পরিবেশ দূষণ রোধে ঢাকার আশপাশের সবগুলো ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনারও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। সিদ্ধান্ত দুটো শক্ত হাতে বাস্তবায়ন করতে হবে।

কিন্তু বড় চিন্তার জায়গা হলো নির্মাণকাজ। যে যেভাবে পারছে নির্মাণকাজ করছে। এজন্য যুগোপযোগী আইন ও নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র ও ‘যে যেভাবে পারে’ নির্মাণ কাজে থেকে বিরত থাকার জন্য প্রশাসনকে বা কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। শুধু মুনাফার কথা না ভেবে মালিক/সমিতি/ডেভেলপারদের দেশ ও ভবিষ্যতের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। শুধু বিবেককে জাগ্রত করলেও সরকারের কঠোর তদারকি লাগবে না। অবশ্য এ ব্যাপারে মালিক-সরকারি কর্তৃপক্ষকেই বিবেক জাগ্রত করতে হবে। শুধু একপক্ষ বিবেক জাগ্রত করে বেশদূর অগ্রগতি সম্ভব নয়। বাতাসে ক্ষতিকর এসব বস্তুকণা মিশছে মূলত যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্পের জ্বালানি এবং কাঠ ও কয়লা পোড়ানোর ফলে।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ আছে। ২০১৮ সালে সংশোধনও করা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বায়ুদূষণ বা পরিবেশ দূষণকল্পে বেশ কিছু আইন-বিধি-নীতিমালা রয়েছে। আইন বাস্তবায়নে আরও কঠোর হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। নিষিদ্ধ এলাকা ও জলাশয়ে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না বলে আইনে উল্লেখ আছে। ইটভাটা স্থাপনে হাসপাতাল স্কুল আবাসিক এলাকাগুলো নিষিদ্ধ।

আবাসিক বলতে ৫০টি ঘর থাকলেই আবাসিক হিসাবে আইনে গণ্য করা হচ্ছে। এরকম স্থান থেকে কমপক্ষে এক কিমি দূরে ভাটা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। আর যেসব স্থানে ছয়মাস পানি থাকে সে স্থানগুলোকে আইনে জলাশয় হিসাবে বলা হচ্ছে। কিন্তু কতদূর বাস্তবায়ন হচ্ছে তা আরিচা-ঢাকা রোডে বা ঢাকার আশপাশের রোডে দেখা যায়। কমপক্ষে ১২০ ফিট চিমনি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আইন ভঙ্গকারীকে সবোচ্চ পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এটা নিয়ে আরও ভাবতে হবে আমাদের।

বায়ুতে বেঁচে থাকার অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে দিচ্ছে। এসবের জন্য দরকার সবুজায়ন। বৃক্ষ রোপণের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প ইটের চিন্তা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারও কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে। আর কিছু উদ্যোগ চালু হওয়ার পথে। আর একটি বড় কারণ হচ্ছে যানবাহনের ধোঁয়া। ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর যানবাহন থেকে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। এখানেও একই অবস্থা। আইন আছে। কিন্তু ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিভিন্ন কারণে।
গণমাধ্যমকে বেশি পরিমাণে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের দুর্দিনে গণমাধ্যমের ইতিবাচক অনেক ভূমিকা থাকে। এ বিষয়েও উচ্চকিত হবে দেশের গণমাধ্যম, তা আমরা আশা করি। ভয়াবহতার অবস্থা তুলে ধরে সচেতনতার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে করণীয় কী কী তা তুলে ধরতে হবে।

জনসচেতনতা সৃষ্টিই পারে বিভিন্ন রকমের দূষণের ভয়াবহতা কমাতে। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। নগরায়ণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। সবুজ বিপ্লব দরকার। বনায়ন দরকার। পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হবে।

আবু আফজাল সালেহ
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 
Electronic Paper