ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মূল্যবোধের শিক্ষা ও সমাজ বাস্তবতা

মো. আবদুর রহিম
🕐 ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০১৯

বাংলাদেশের শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এতদুদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো পাঠ করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, ন্যায়বিচারবোধ ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাছাড়া, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার ওপর শিক্ষামূলক গল্প ও উপদেশমূলক কথা বলার জন্য শিক্ষকদের প্রতি নির্দেশনা আছে। তবে শুধু উপদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সামনে এমন কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যা সহজেই শিক্ষার্থীদের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

অর্থাৎ একজন শিক্ষক নিজে কতটা সৎ, কতটা দেশ-প্রেমিক, কতটা মানবিক তা তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। তাহলেই শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের কথায় ও কাজে বিশ্বাস স্থাপন করে নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হতে পারবে। এজন্য ‘Example is better than precept’ কথাটার মধ্যে আমি খুব গুরুত্ব খুঁজে পাই। কারণ, বর্তমান প্রজন্মের বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে উপদেশমূলক কথা শুনতে নিস্পৃহভাব দেখায়। বড়রা সব সময় ছোটদের বলেন, ‘সদা সত্য কথা বলিও’, ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘দরিদ্রকে উপহাস করিও না’, ‘দেশকে ভালবাসিও’ ইত্যাদি। এসব কাজ যদি বড়রা ছোটদের সামনে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তাহলে ছোটরা দেশপ্রেম, মানবিকতা ও নৈতিকতার বাস্তব শিক্ষা পেতে পারে।

কতজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেন, তারা গৃহপরিচারিকাদের প্রতি কিরূপ আচরণ করে? একটা কাজের মেয়ে যখন কোনো বাসায় গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী কর্তৃক নির্যাতিত হয়, তখন তাদের ছেলেমেয়েরা কি কাজের মেয়েটির পক্ষে কথা বলে?

আপনি শিক্ষক হিসেবে আপনার কাজের মেয়েটার সঙ্গে কী আচরণ করেন বা আপনার পরিবারের অন্য সদস্যরা কী আচরণ করে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অবহিত করুন। শিক্ষার্থীদের বলুন, আপনি আপনার বাসার কাজের মেয়ে বা ছেলেকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করবেন না, ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেন। এমনকি আপনার ছেলেমেয়েরা আপনার কাজের ছেলে বা মেয়েকে বয়সভেদে ‘তুমি’ বা আপনি বলে সম্বোধন করে। আর এটাই হবে শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। শিক্ষার্থীদের বলুন, যদি তাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি তাদের বাবা-মা দ্বারা নির্যাতিত হয়, তাহলে তারা যাতে বিনয়ের সঙ্গে তাদের বাবা-মাকে বোঝান, এদের প্রতি মানবিক হতে। এভাবে শিক্ষার্থীরা মানবিকতা শিখতে পারে।

শিশুরা নৈতিক মূল্যবোধ শিখে থাকে প্রথমত তাদের পরিবার থেকে। এরপর সমাজ, রাষ্ট্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে তারা নৈতিক মূল্যবোধের ধারণা লাভ করে। শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষা দানের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একটা বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু আমাদের সমাজ শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষাদানের পুরো দায়িত্ব শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপাতে চায়। তাই স্কুল ইউনিফর্মধারী কোনো ছেলেমেয়ে যদি রাস্তাঘাটে কারও সঙ্গে বেয়াদবি করে বা কোনো আপত্তির কাজ করে, তাহলে সমাজের লোক তাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে, ‘তুমি কোন স্কুলে পড়? তোমার শিক্ষকরা কি এই শিক্ষাই তোমাকে দিয়েছে? বস্তুত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এককভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারে না এবং তা সম্ভবও নয়।

নৈতিক মূল্যবোধ কি শুধু আদব-কায়দার মধ্যে সীমাবদ্ধ? শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং অসৎ কাজ বর্জন করা ও সৎ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। এমন কোনো ছেলেমেয়ে কি আমাদের সমাজে আছে, যে তার বাবার অবৈধ রোজগারের ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারবে? কোনো ছেলে বা মেয়ে কি তার বাবাকে প্রশ্ন করতে পারবে, ‘বাবা তোমার বেতন তো সীমিত, আমাদের এত টাকা আসে কোত্থেকে? তুমি ঘুষ, দুর্নীতি বন্ধ কর, না হয় আমি খাব না, স্কুলেও যাব না।’ বাবা ঘুষখোর হলেও কোনো ছেলে বা মেয়ে তার বাবাকে এভাবে প্রশ্ন করবে না বরং বাবার অবৈধ টাকায় তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে দিনাতিপাত করে বলে বাবার প্রতি তারা কৃতজ্ঞই থাকে।

দুর্নীতিবাজ বা ঘুষখোরের সন্তানরা যদি সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে, তাহলে তারা তাদের বাবাকে অবৈধ রোজগারের ব্যাপারে বিব্রতকর প্রশ্ন করবে কেন? এক্ষেত্রে সমাজেরও দায়িত্ব আছে। যারা দুর্নীতিবাজ, তারা তো অনেকটা চিহ্নিত। তারা তো আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এসব দুর্নীতিবাজ আবার দান-দক্ষিণা করে সমাজে জনপ্রিয় হতে চায়। দুর্নীতিবাজদের কি সমাজ একঘরে করতে পারে না? দুর্নীতিবাজদের সন্তানরা যদি সমাজে চলতে গিয়ে প্রশ্নবানে জর্জরিত হতো এবং তাদের বাবার অবৈধ রোজগারের জন্য যদি অন্যান্য ছেলেমেয়েরা তাদের এড়িয়ে চলত, তাহলে ওই ছেলেমেয়েরাই তাদের বাবাকে সৎ ও পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করত।

তাছাড়া আজকাল বেশিরভাগ শিক্ষার্থী খেলাধুলা, সংগীত, বিতর্ক ইত্যাদি সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে চায় না। এ সমস্ত কার্যক্রমের প্রতি তাদের এত অনীহা কেন? এগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। একটা ধারণা অভিভাবকদের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে, সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করলে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নষ্ট হয়। এজন্য অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের এসব কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে সব ছেলেমেয়ে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তারা বেশিরভাগই দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার থেকে আসা।

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল টিমের কতজন সদস্য বিত্তবানদের মেয়ে? বিত্তবানদের সন্তানদের এ সমস্ত খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সময় বা সুযোগ কোথায়? স্কুল ছুটির আগে ও পরে তারা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে নিয়োজিত থাকে। আজকাল মধ্যবিত্তের সন্তানরাও চরমভাবে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিমুখ হয়ে পড়ছে এবং জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তির লক্ষ্যে কোচিং সেন্টারমুখী হচ্ছে। জিপিএ-৫-এর পেছনে নিরন্তর ছুটে চলার কারণে শিক্ষার্থীরা সহপাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় ডাবল জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীরা একধাপ এগিয়ে থাকে বলেই জিপিএ-৫-এর প্রতি তাদের এত আকর্ষণ। যে সব ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ধরনের সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম বয়ে আনে তাদের অধিকাংশই বিদ্যালয়ের টার্মিনাল পরীক্ষায় বা পাবলিক পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত গ্রেড নিশ্চিত করতে পারে না। কারণ সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে ভালো করার জন্য তাদের প্রচুর অনুশীলন করতে হয়। এজন্য অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে দিতে চান না।

সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ না করলে শিক্ষার্থীরা সামাজিক মূল্যবোধ, নেতৃত্ব, সহিষ্ণুতা শিখবে কীভাবে? যারা এ সমস্ত কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করে না, তাদের অধিকাংশই চরম স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার মধ্যে বড় হয়। অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী একটা চরম অমানবিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে। ঘুম থেকে উঠেই কোচিং সেন্টারে গমন, তারপর স্কুল এরপর স্কুল থেকে আবারও কোচিং সেন্টারে। কোনো কোনো শিক্ষার্থীর বাসায় রাত ১০টা পর্যন্ত প্রাইভেট টিউটরের যাতায়াত চলে। এসব ছেলে-মেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে চেনার সুযোগ পায় না। তারা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে মিশতে চায় না। তাদের অভিভাবকরা তাদের চারদিকে একটা নিষ্ঠুর পরিবেশ গড়ে তোলেন।

লক্ষ্য করা গেছে, শহরের অনেক ছেলেমেয়ে তাদের পিতামহের বাড়ি কোথায় জানে না। কারণ জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে তারা তাদের দাদার বাড়ি বেড়ানোর সুযোগই করতে পারে না। আরেকটা কঠিন বাস্তবতা এখানে উল্লেখ করতে চাই। এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে হয়। এই পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে চলে যায়। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সুযোগটাও নেই। এভাবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে এইচএসসি পর্যায় পর্যন্ত এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ছেলেমেয়েরা খাঁচার পাখির মতো বন্দি জীবনযাপন করে। এতে সামাজিক ও নৈতিক গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না।

আমি অনেক বছর ধরে বিটিভির বাংলা ও ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাই। তাছাড়া আন্তঃশ্রেণি বিতর্ক ও স্থানীয় বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করি। অভিজ্ঞতা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না।

যেসব শিক্ষার্থী সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করে তাদের স্কুলের টার্মিনাল পরীক্ষায় এবং পাবলিক পরীক্ষায় তাদের রেকর্ডের ভিত্তিতে প্রতি বিষয়ে ৫% বা ১০% নম্বর প্রদানের ব্যবস্থা করলে দেশে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। ফলে, প্রায় সব শিক্ষার্থীই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহ-পাঠক্রমিক কাজে অংশগ্রহণ করবে। একই সঙ্গে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত হবে এবং এভাবেই তাদের মধ্যে দেশপ্রেমও জাগ্রত হবে। সম্প্রতি একটা ট্রেনিং কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে জানলাম, শিক্ষার্থীদের সার্বিক আচার-আচরণ ও সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলীকে ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা চলছে।

মো. আবদুর রহিম : সহকারী শিক্ষক;
সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা
উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

 
Electronic Paper