ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রযুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি অচল

মনসিজ মজুমদার
🕐 ৯:৩৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৮

আজকাল হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের কল্যাণে খুব দূর-দূরান্তের বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে সহজেই সংযোগ রাখা যায়, কথা বলা যায়। আবার স্কাইপের চাক্ষুস দূরভাষে প্রিয়জনকে দেখা যায়। আজকের এই সংযোগ বিপ্লবের দিনে কল্পনাও করা যায় না, ছয় কি সাতের দশকের ছেলেরা যখন বিদেশে চলে যেত, বাবা-মার মনে হতো তারা গ্রহান্তরে চলে গিয়েছে।

মাসে একবার, কখনো দুই মাসে চিঠি আসত-যেত। আর টেলিফোনে গলা শুনতে অনেক সাধ্য-সাধনা করতে হতো। কারণ, দূরভাষে সাগরপারের লাইন পাওয়া ছিল প্রায় সৌভাগ্যের কথা। আর ‘দূরভাষ’-নামক যন্ত্রটি ছিল মূর্তিমান যন্ত্রণা। একবার মনে আছে, ‘যন্ত্রধ্বনি’ শুনে রিসিভারে কান রাখতেই কানের পর্দায় ঘা দিতে থাকল বিকট কণ্ঠস্বরে অশ্রাব্য গালিশব্দ। মিনিট দুয়েক পরে তিনি থামতেই আমি যেই জানতে চাইলাম, তিনি কাকে চাইছেন, তিনি প্রচণ্ড রেগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। রাগটা আমার ওপর না টেলিফোনের ওপর করলেন বোঝা গেল না।
সংযোগ ব্যবস্থার দুরারোগ্য ব্যাধি আস্তে আস্তে সারতে লাগল নয়ের দশকে। বলা উচিত সেলফোন, কম্পিউটার আমাদের দেশেও আর ‘বিদেশি জিনিস’ রইল না। এসব সম্ভব হলো কারণ, ভারতীয় অর্থনীতির এক বিরাট পরিবর্তন হলো বিশ্বায়নের ফলে। যখন হলো, তখনো আমাদের চেতনা ‘বিশ্বায়িত’ হয়নি কারণ, বিশ্বায়ন হলেও এসব বিস্ময়কর প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিল না। বিদেশাগত বন্ধু-স্বজনদের কাছে কেবল বাঁশি শুনেছিলাম, ‘তারে চোখে দেখিনি’।
বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন বামপন্থীরা, বিশেষ করে সদ্যপ্রয়াত অশোক মিত্র। বিদেশি পুঁজির কুক্ষিগত হয়ে পড়বে আমাদের অর্থনীতি। পেছনের দরজা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ ঘটবে। এমন সব আলোচনা তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকল।
আমি আর আমার সাংবাদিক বন্ধু বিক্রমন নায়ার একদিন গেলাম আমার প্রতিবেশী ধীরেশ ভট্টাচার্যের কাছে, যিনি ছিলেন ভারতীয় অর্থনীতির ভারতব্যাপী খ্যাতিমান অধ্যাপক, যার কাছে প্রতিবছর রাজ্য বিধানসভায় বাজেট পেশের আগে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত আসতেন পরামর্শর জন্য। ধীরেশবাবু বিশ্বায়ন নিয়ে আমাদের আশঙ্কা বা সংশয়ের কোনো কারণ আছে বলে মনে করলেন না বরং ভরসা দিলেন আমাদের নেতারা এবং ভারতীয় পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থেই এমনটা ঘটতে দেবে না। আমরা যে আশ্বস্ত হয়ে চলে এলাম তা নয় বরং যখন মোবাইল ফোন সার্ভিস চালু হলো তখন যন্ত্রের দাম ও সেবা পাওয়ার খরচ শুনে চক্ষু চড়কগাছ হলেও মনে হলো, এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের কোন উপকারে আসবে?
অবশ্য ‘সাধারণ মানুষ’ বলতে আমাদের শ্রেণির কথাই ভেবেছিলাম। তারপরে যখন কম্পিউটার এলো তখনো তা আমাদের মতো ‘সাধারণ’-এর কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হলো না এবং অনেকের কাছেই কম্পিউটার ব্যবহার এবং কার্যকারিতা এক দুরূহ এবং দুর্বোধ্য ব্যাপার বলে মনে হলো, বিশেষ করে চল্লিশ অতিক্রান্ত প্রজন্মের কাছে। কিন্তু যখন অফিস-কাছারিতে কম্পিউটারের ব্যবহার চালু হতে লাগল তখন গেল গেল রব উঠল। কারণ, দেখা গেল কম্পিউটার একাই একশ এবং মানুষ যে কাজ করে তিন ঘণ্টায়, কম্পিউটারে নাকি তা হয় তিন মিনিটে এবং নির্ভুলভাবে! টাইপিস্ট এবং কেরানির পদে লোক নিয়োগের আর প্রয়োজন হবে না-এমন সুনিশ্চিত সম্ভাবনার আশঙ্কায় কম্পিউটার ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদী আন্দোলন হতে লাগল।
কিন্তু প্রযুক্তির বিরুদ্ধে কোনো যুক্তিই খাটে না এবং পুরনো প্রযুক্তি যাদের জীবিকার আশ্রয় ছিল নতুন প্রযুক্তির অনিবার্যতায় তারা মারা পড়ে। এমনটাই হয়েছিল নৌকা, পালকি বা গরুর গাড়ির প্রযুক্তিনির্ভর জীবিকায় যারা ছিল তাদের, যখন কি না, রেলগাড়ি ঝমাঝম ছুটতে থাকল দিকে দিকে। এখন আর বিশ্বায়নের ‘সর্বনাশা’ অভিঘাতের কথা কেউ তোলে না। বিশ্বায়নের ফলে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তির গণব্যবহারের ব্যাপকতায় এবং সেই সম্পৃক্ত ব্যবসা ও বৃত্তির প্রসারে এখন কম্পিউটার বা মোবাইল ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না।
মোবাইলহীন অতীতের কী ঘটনা এখন ঘটত না, এমন একটা মন্তব্য করলেন কিছুদিন আগে অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্কর। পরিচালক মৃণাল সেনের জন্মদিনে এক আলোচনা সভায়। তিনি বলছিলেন, মৃণাল সেনের ছবিতে তার অভিনয় করার উজ্জ্বল স্মৃতিকথা। ‘একদিন প্রতিদিন’-এ একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র চাকুরে সন্তান চিনু বা চিন্ময়ীর ভ‚মিকায় তিনি অসামান্য অভিনয় করেছিলেন। ছোট ভূমিকা, ছবিতে উপস্থিতি স্বল্প সময়ের। কিন্তু তার অনুপস্থিতি নিয়েই গোটা ছবিটা। ঘটনাই বা কী, আজকের দিনে হলে এমন ঘটনা ঘটতই না। ‘কারণ, এখন তো মোবাইল ফোন আছে।
কেবল মোবাইল ফোন আছে বলেই, আজকের দিনে একটি তরুণী মেয়ে রাত-দুপুর পর্যন্ত বাড়ি না ফিরলে সমাজ-সংসার আতঙ্ক-উদ্বেগ-কুৎসায় আলোড়িত হতো না, তা বোধহয় নয়। ‘একদিন প্রতিদিন’ সময়ের ছবি, আজকের ‘একদিন প্রতিদিন’ হতো এক ভিন্ন সময়ের ছবি এবং সে ছবিতে থাকত মেয়েদের প্রতি মাংসলোলুপ পুরুষের মড়কের মতো নিষ্ঠুরতার আরও করুণ কাহিনী।
একথা ঠিক, আজকের তরুণীরা রাস্তাঘাটে, বাসে-মেট্রোয় এমনভাবেই মোবাইল ফোন আঁকড়ে থাকেন, মনে হতেই পারে যেন সেটি হাতে থাকলে তিনি হাজার লোকের মাঝে ‘রয়েছি একেলা যে’ মনে করেন না। যেন সেলফোন তার আত্মরক্ষার ভরসা। কিন্তু কমিউনিকেশন বিপ্লবের সুফল ব্যাপক হারে জনগণের আয়ত্তে আসা সত্ত্বেও মহিলাদের নিরাপত্তা বাড়েনি বরং কমেছে। যে ধরনের বিপদের আশঙ্কা আজকাল প্রথমেই মনে আসে অনেক রাতেও পথে থাকা কোনো নিঃসঙ্গ মহিলা সম্পর্কে, ‘একদিন প্রতিদিন’-এ অবশ্য চিনুর বাবা-মা-ভাই বা কোনো প্রতিবেশী তা নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা যায়নি।
আজকাল স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মেয়েদের হেনস্তা করা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তি এখন দুষ্কৃতিদের হাতে হাতে ঘুরছে। ফটোশপে অন্যের নিরাভরণ দেহ পরিচিতার মুখের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সে ছবি ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে প্রচার করে তার জীবন চিরকালের মতো বিষিয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে নারীর জীবন-মরণ নির্ভর করে খাপ পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তের ওপর, সেসব জায়গায় নারীর গণধর্ষণ বা উন্মত্ত জনতার তাকে পুড়িয়ে মারার নির্মম দৃশ্য স্মার্টফোনে ভিডিও করে প্রত্যেকের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছে তারা। কেবল দূর গ্রামাঞ্চলে নয়, সম্প্রতি কলকাতার রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলেই একটি নাবালিকা বস্তিবাসিনীর স্নানের দৃশ্যের ভিডিও তুলে প্রচার করার ভয় দেখিয়ে তাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করা হয় কয়েক মাস ধরে। আবার একদিন স্নানের দৃশ্য তোলার চেষ্টা করায় মেয়েটির চেঁচামেচিতে পাড়া-প্রতিবেশী ছুটে এসে লোকটিকে ধরে পুলিশে দেন।
ছেলেবেলায় ইশকুলে একটা রচনা লিখতে হতো, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? এই প্রশ্নের বোধহয় একমাত্র উত্তর হতে পারে বিজ্ঞান আশীর্বাদ বা অভিশাপ কোনোটাই নয়। মানুষই তাকে আশীর্বাদ বা অভিশাপ বানায়।
সবশেষে ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবি সম্বন্ধে দুটি অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা বোধহয় প্রাসঙ্গিক হতে পারে। রাজ্যসভায় নার্গিস যখন বলেছিলেন, ‘পথের পাঁচালী’ ভারতের দারিদ্র দশা বিশ্বে প্রচার করেছে, তখন প্রতিবাদী তর্কালোচনার মধ্যে কেউ বলেছিলেন, দারিদ্র, দুঃখ-কষ্ট না থাকলে মহৎ শিল্প হয় না। কবিই তো বলেছেন, ‘দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান’।
মহৎ শিল্প সৃষ্টির জন্য এমন দাবি বিভূতিভূষণও করতেন না। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়েই মহৎ শিল্প রচনা করতে পারেন শিল্পী। অতি সীমিত অভিজ্ঞতার মহিলা ছিলেন আঠারো শতকের ব্রিটিশ লেখিকা জেন অস্টেন। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা নিয়েই তিনি লিখেছিলেন অমর উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’। আগেই বলেছি, ‘একদিন প্রতিদিন’ আজকের ছবিও হতে পারত। কিন্তু তার জন্য মেয়েদের চিরকাল মধ্যযুগে পড়ে থাকতে হবে এমন ভাবনা হাস্যকর। ‘একদিন প্রতিদিন’ দেখে বাসে উঠেছি। সহযাত্রীদের একজন বলে উঠলেন, হয়তো আমারই উদ্দেশে, ‘ফিল্মটা কিস্যু হয়নি, আসল ব্যাপারটাই তো জানা গেল না। সারারাত মেয়েটা কোথায় ছিল?’ সত্যজিৎ রায়ও নাকি জানতে চেয়েছিলেন, মেয়েটি কোথায় ছিল? হয়তো তার অনুসন্ধিৎসায় ছিল বাস্তবতার তাগিদ। ছবির প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে নয়। কারণ, তিনি জানতে চেয়েছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র তরুণর কে কী চাকরি করে। উত্তরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নাকি বলেছিলেন, তার উপন্যাসের জন্য তথ্য আদৌ জরুরি নয়। কিন্তু সত্যজিতের কাছে তা জরুরি ছিল।

মনসিজ মজুমদার : লেখক, কলামিস্ট
[email protected]

 
Electronic Paper