আসামে বিভাজনের খেলা
তপোধীর ভট্টাচার্য
🕐 ৯:৩৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০১৮
নাগরিকপঞ্জি নবায়নের নামে আসামে যে ফ্যাসিবাদী তাণ্ডব চলেছে, এর তাৎপর্য বহুমুখী। এখনোই সেসব বিশ্লেষণ করা দরকার। কেন না, মুখ্যত বাঙালি এবং গৌণত অনসামিয়া ক্ষুদ্র ভাষা গোষ্ঠীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে চক্রান্তের জাল তৈরি হয়েছে, তা যদি সফল হয়, দেশবিরোধী অপশক্তি সর্বত্র উৎসাহিত হয়ে উঠবে।
ভারতীয় সংবিধানের মৌলনীতিগুলো যদি নস্যাৎ হয়ে যায়, মানবাধিকার ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়-ভারত কি আর ভারত থাকবে? ১৯৪৭ থেকে যে হিংস্র বাঙালি বিদ্বেষ, জাতি-বৈরতা ও তীব্র অসহিষ্ণুতা আসামের রাজনীতির প্রধান অন্তর্বস্তু হিসেবে মান্যতা পেয়ে গেছে, এর বিষক্রিয়ায় জাতীয় সংহতির বোধ অসাড় হয়ে যেতে বাধ্য।
আসাম আসলে অন্তর্ঘাতকদের পরীক্ষাগার। ঘৃণাকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদ যদি আমলাতন্ত্র, গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাধারাকে লাগাতার অপপ্রচার দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলতে পারে, তাহলে সেই মারণাস্ত্র ভারতের সব অঙ্গরাজ্যে ভাষিক বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থার নিয়ামকরা যদি এই সবচেয়ে জরুরি কথাটি না বুঝতে চান, তাহলে দেশের অকল্যাণ রোধ করা যাবে না।
খুবই পরিতাপের কথা, প্রবল রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ আসামের ভয়ঙ্কর ঘটনাপ্রবাহ সম্বন্ধে প্রায় সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। অথচ মাত্র একটি প্রজন্ম আগেও নিয়মিতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের সচেতন মানুষ সুনির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আসামে বাঙালি-বিতাড়নের তাণ্ডব সামান্য মনোযোগও পাচ্ছে না। অনেকের মধ্যে এমন ধারণাও রয়েছে, আসামে অসমিয়া থাকবে না তো কারা থাকবে? কিন্তু আসামের বাস্তব মোটেই সরল অঙ্ক নয়।
২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী, আসামের মোট ৩ কোটি ১২ লাখ মানুষের মধ্যে ৯০ লাখই বাংলা ভাষী হিন্দু-মুসলমান। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, তিন-চার পুরুষ আগে পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব কৃষক মজুররা আসামে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই জনগণনার সময় আত্মরক্ষার জন্যে নিজেদের মাতৃভাষা পাল্টে নিয়েছিলেন। কিন্তু নাগরিকপঞ্জি নবায়নের সময় দেখা গেল, মুখ্যত বাঙালি মুসলমান সমাজের এসব মানুষও হয়রানির শিকার। সুতরাং, অসমের নানা প্রান্তে পূর্ববঙ্গ মূল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রবল অনিশ্চয়তাবোধ ও আতঙ্ক সক্রিয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিকার করা যাদের লক্ষ্য, তারা এই ভয়, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তাবোধকেই খেয়া পারানির কড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে। এটা নিশ্চয়ই আদর্শ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। সত্যিই এই হতাশা সব ভাষিক সংখ্যালঘুর, বিশেষভাবে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের। বিচারব্যবস্থায় যদি আর্তের কথা না পৌঁছায় এবং ইতিহাসের প্রকৃত তথ্য উপেক্ষিত হয়- তাহলে বিপন্ন বাঙালি হিন্দু-মুসলমান কোথায় দাঁড়াবে? রাজনৈতিক দলেরা নিশ্চুপ, মানবাধিকারকর্মীরা উদাসীন এবং সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। তার ওপর সুপরিকল্পিতভাবে চলছে বিভাজনের খেলা। ভারতীয় গণতন্ত্রের মর্যাদা তাহলে থাকল কোথায়? আসামে সেই যে দেশভাগের সময় থেকে বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্র হয়ে উঠল, তা এই ২০১৮ সালে হিংস্র আততায়ীর উল্লাসে পরিণত হয়েছে। তবে ইতিহাসের মহাফেজখানায় এসবই সভ্য সমাজের বিপরীত চলনের কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু বাঙালি হওয়ার অপরাধে যদি লাখ লাখ মানুষ নব্য-রোহিঙ্গা বা নব্য-ইহুদিতে পরিণত হয়, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের চরিত্র কি বিশাল প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যায় না? যাদের নাম বাদ পড়বে, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো পুরুষানুক্রমে আসামে রয়েছেন। তাদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যার মানুষ হয়তো জন্মানোর এক বছরের মধ্যে বার্থ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করেননি। ছেলেবেলায় দেখেছি, আমাদের অভিভাবকরাও এ বিষয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। কিন্তু রাজ্যিক সমন্বয়কের মনে হয়েছে, এই ‘ত্রুটি’কে কাজে লাগিয়ে হতভাগ্য বাঙালিদের ধনে-প্রাণে মারবেন। এবং, বিস্ময়ের কথা এই, এহেন তুঘলকি ফরমানও সর্বোচ্চ আদালতে মান্যতা পেয়ে যায়!
যদি কেউ ভাবেন, এই লাখ লাখ মানুষ যাবে কোথায়? এদের কি কুকুর-বিড়ালের মতো মনে করা হবে? এর জবাব নেই। কিছুদিন আগে রাজ্যিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরের নেতারা হুঙ্কার দিয়েছেন, এসব রাষ্ট্রহীন জনসমষ্ঠির কোনো অধিকারই থাকবে না। তারা কিংবা তাদের সন্ততিরা স্কুল-কলেজে ঠাঁই পাবে না, ব্যবসা করার অনুমতি পাবে না, জমি কেনা বা ঘর তৈরির অনুমতি পাবে না। সম্ভবত তাদের জমি-জিরাত, ঘরবাড়ি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি সবকিছু কেড়ে নেওয়া হবে। এদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল বন্ধ করা হবে।
অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদী জার্মানিতে যেমন ইহুদিদের ঘেটোয় বন্দি করে রাখা হয়েছিল, বাঙালিদের জন্য সেই চমৎকার ব্যবস্থা এরা ভেবে রেখেছে।
ভাবা যায়, স্বাধীন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে এমন মানবতাবিরোধী জঘন্য চক্রান্ত চলেছে? অথচ পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারত নির্বিকার। বাম-দক্ষিণ-মধ্যপন্থী বড় ও মাঝারি রাজনৈতিক দলগুলো এত বড় মাপের ঘটনা সম্পর্কে টুঁ শব্দটিও করছে না। কেননা, এরা তো হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান নীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক। এবং, বাঙালিরা আবর্জনা মাত্র!
তারা নিজেদের অনড় ভোটের অঙ্কে হিন্দু দেখেন, মুসলমান দেখেন কিন্তু মানুষ দেখেন না। মানুষের ওপর বর্বর অত্যাচারের নিদর্শন দেখেন না। দেখেন না আসামে গজিয়ে ওঠা সভ্যতাবিরোধী ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো, যা আসলে হিটলারের জমানার কুখ্যাত মৃত্যু-শিবিরের ছায়ায় তৈরি। নাগরিকপঞ্জি নবায়নের নামে হলোকাস্টের দীর্ঘতর ছায়া দেখতে পান না ভারতীয় গণতন্ত্রের পতাকা বাহকেরা। এতে যে আন্তর্জাতিক স্তরে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া ফিলিস্তিন বা মিয়ানমারের উৎখাত রোহিঙ্গাদের মতো, সম্প্রতি ইউরোপের বা আফ্রিকার অসহায় ভাসমান জনগোষ্ঠীর মতো লাখ লাখ বাঙালিকে, শুধু বাংলা ভাষী হওয়ার অপরাধে, স্বাধীন ভারতে উৎখাত করার চক্রান্ত হয়েছে-এই নিদারুণ তথ্য কি পশ্চিমবঙ্গসহ বহির্ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষেরা বা মানবাধিকারকর্মীরা দেখেও দেখবেন না।
তপোধীর ভট্টাচার্য : আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।