ভুল করার জো নেই আর
কৌশিক ভৌমিক
🕐 ৯:৩৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৪, ২০১৮
দেখে বোঝা গিয়েছিল ম্যারাডোনা হাত লাগিয়েই বলটা ঠেলে দিলেন ইংল্যান্ডের গোলে। নজর এড়িয়ে যায় রেফারির। ’৮৬-র বিশ্বকাপে ২-১ ব্যবধানে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় আর্জেন্টিনা।
খেলা শেষে ম্যারাডোনা বলেন, ওটা ছিল ‘হ্যান্ড অব গড’। তিন দশক পরে, বিশ্বকাপ উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে তার স্বীকারোক্তি: এই প্রযুক্তি সেই সময় থাকলে আমার ‘হ্যান্ড অব গড’ ধোপে টিকত না। আর একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি, এই ভিএআর আমাকে হাজতবাস করিয়ে ছাড়ত!
ভিএআর-ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি। এক ধরনের উন্নত ভিডিও প্রযুক্তি।
যা খেলার প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি নিখুঁতভাবে তুলে পাঠিয়ে দেয় এক দল বিশেষ রেফারির কাছে, তাদের মূল্যায়নের জন্য। ২০১৮-র ফুটবল বিশ্বকাপে এই পদ্ধতি নতুন সংযোজন।
এবারের বিশ্বকাপ শুধু ফুটবলের নয়, প্রযুক্তিরও। বলা চলে, ডিজিটাল বিশ্বকাপ। ক্যামেরার কেরামতিতে খেলার যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি শনাক্ত করে ফুটবলকে আরও স্বচ্ছ বিনোদনের উপকরণ করে তোলার বিশ্বকাপ। ভিএআরের পাশেই এবার আর এক দল ক্যামেরা তাক করা গোললাইনের দিকে।
বল বারে লেগে গোললাইনের কয়েক চুল ভেতরে না বাইরে পড়ল, ছবি তুলে নেয় তারা। যে সূক্ষ্ম তফাত রেফারির খালি চোখে নির্ণয় করা দুষ্কর। এই প্রযুক্তির নাম গোললাইন টেকনোলজি (জিএলটি)। জিএলটি নিখুঁতভাবে জানিয়ে দেবে বলটা বারে লাগার পর গোললাইনের ভেতরের মাটি ছুঁয়ে বেরিয়ে এসেছে, না কি লাইন অতিক্রমই করেনি। জিএলটির ছবি দেখে রেফারি জানাবেন গোল ব্যর্থ, না উল্লাস যথার্থ।
১৯৮৬-র বিশ্বকাপে ভিএআর প্রযুক্তি থাকলে যেমন ‘হ্যান্ড অব গড’ এড়ানো যেত, ১৯৬৬-র বিশ্বকাপে জিএলটি হাজির থাকলে অব্যাহতি মিলত গোলসংক্রান্ত আর এক বিতর্কের ঝড় থেকে। কী ঘটেছিল বাহান্ন বছর আগের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে? ইংল্যান্ডের জিয়ফ হার্স্টের শটে বলটা ক্রসবারে লেগে পড়েছিল। ইংল্যান্ডের দাবি ছিল, বল পড়েছে গোললাইনের ভেতরে। জার্মানদের দাবি, বাইরে।
রেফারি ইংল্যান্ডকে গোলটা দিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড ৪-২’তে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে জুলে রিমে কাপ জিতে নেয়। কিন্তু ওই গোল নিয়ে বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে আজও বিতর্ক রয়ে গিয়েছে। অনুরূপ ঘটনা ২০১০ বিশ্বকাপেও।
জার্মানি ও ইংল্যান্ডের নকআউট ম্যাচ। ইংল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের শটে বল ক্রসবারের নিচে লেগে মাটিতে ড্রপ খেতেই পাকড়াও করে ফেলেন জার্মান গোলরক্ষক।
ইংল্যান্ডের দাবি ছিল, বল গোললাইন পেরিয়েছে। নস্যাৎ করে দেন রেফারি। বেঁধে যায় তুমুল বিতর্ক। ম্যাচ হারে ইংল্যান্ড। ভুল স্বীকার করে ফিফা। ইতোমধ্যে কিন্তু বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে ইংলিশ টিম। শিক্ষা হয় মান্ধাতামনস্ক ফিফার। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে চিন্তাভাবনা শুরু করে গোললাইন প্রযুক্তি ব্যবহারের।
‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ থেকে এ ধরনের যাবতীয় বিতর্ক ও বিচ্যুতির ভ্রূকুটিকে নির্মূল করতে মাঠে নেমে পড়েন ফিফার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জিয়োভান্নি ইনফান্তিনো। প্রশাসক হিসেবে এটা তার প্রথম বিশ্বকাপ।
খেলার মানোন্নয়নের জন্য তিনি বিশ্বকাপে এনেছেন ভিএআর, জিএলটির মতো প্রযুক্তি। ফুটবলের দুনিয়ায় সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’।
যদিও ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে গোললাইন প্রযুক্তি প্রথম ব্যবহার করে ২০১৪ সালে। সেপ ব্ল্যাটার তখন ফিফার সর্বময় কর্তা। তবুও বলা যায়, তার ১৭ বছরের কার্যকালে, ব্ল্যাটার বিশ্ব ফুটবলে প্রযুক্তিকে অচ্ছুত করে রেখেছিলেন। ফুটবল তার কাছে আবেগের খেলা, যাতে থাকবে শুধু মানব-স্পর্শ। খেলোয়াড়দের ভুলচুক হবে, কোচদের গলদ থাকবে, রেফারিরা মাঝেমধ্যে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনো রকমের প্রযুক্তির যান্ত্রিকতা ঢোকানো চলবে না এই খেলায়।
ইনফান্তিনো কিন্তু ফিফার দায়িত্ব নিয়ে ফুটবলে মানব-আবেগের সঙ্গে প্রযুক্তির আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সুকৌশলে।
ফিফা এবার বিশ্বকাপে সনির হক-আই ইনোভেশনসের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। মাঠ ঘিরে স্টেডিয়ামের ওপর থেকে হরেক অ্যাঙ্গলে ফোকাস করা চৌদ্দখানা হাই প্রিসিশন ক্যামেরা। সাতটা করে ক্যামেরা দুদিকের গোলের অভিমুখে তাক করা। সেকেন্ডে পাঁচশ ফ্রেম গতিতে ছবি তোলে ক্যামেরাগুলো।
সেই ফুটেজ নিমেষে পাঠিয়ে দেয় ইমেজ প্রসেসিং কম্পিউটারে। বিশেষ সফটওয়্যার গোলের মুখে খেলোয়াড়-রেফারির জটলাকে বাদ দিয়ে শুধু বলের অবস্থান নির্ণয় করে, তার থ্রিডি ছবি বানিয়ে, ধরে ফেলে, বল গোললাইন অতিক্রম করেছে কি না। সেই খবর এক সেকেন্ডের মধ্যে পাঠিয়ে দেয় ম্যাচ রেফারির হাতে পরা স্মার্টওয়াচে।
ভিএআরের কাজেও রয়েছে ক্যামেরার কারসাজি। তবে গোললাইন প্রযুক্তির থেকে এর কর্মপদ্ধতি আলাদা।
রাশিয়ার এগারোটা শহরের যে বারোটা স্টেডিয়ামে এবারের বিশ্বকাপ খেলা চলছে, তাতে সাকুল্যে ৩৩টা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্রডকাস্ট ক্যামেরা বসানো। এর মধ্যে আটটা সুপার স্লো মোশন, চারটে আল্ট্রা স্লো মোশন। অফসাইড ধরার জন্য আছে আরও দুখানা ক্যামেরা।
যাবতীয় ক্যামেরা ফিড পর্যবেক্ষণের জন্য ভিএআর টিমে আছেন ফিফার তেরোজন সদস্য। এর মধ্যে একজন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ভিডিও রেফারি। এরা বসেন মাঠ থেকে বহু দূরে, মস্কোর ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্ট সেন্টারের ভিডিও অপারেশন রুমে।
খেলার প্রতিটা মুহূর্তের ফুটেজ ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক মারফত চলে যায় ভিডিও অপারেশন রুমে। তার ভিত্তিতে দূরস্থিত রেফারিরা খেলার চারটে বিশেষ ক্ষেত্র কম্পিউটারে যাচাই করেন: গোলের বৈধতা (গোলদাতা অফসাইডে ছিল কি না), পেনাল্টির সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক (বক্সের ভেতরে ফাউল বা হ্যান্ডবল হয়েছে কি না), যে খেলোয়াড় সরাসরি লাল কার্ড দেখেছেন তার দোষ কতটা গুরুতর, এবং নির্দোষ খেলোয়াড়কে ভুলবশত শাস্তি দেওয়া হয়েছে কি না।
কোনো বিষয়েই ম্যাচ রেফারি যদি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন বা খেয়াল না করে থাকেন, তখনই ভিএআর টিম রেফারির ইয়ারফোনে সতর্কবার্তা জানিয়ে দেয়। রেফারি তখন খেলা থামিয়ে মাঠের বাইরে বসানো কম্পিউটারে ভিএআরের অনফিল্ড রিভিউ দেখে ঠিক করেন নিজের সিদ্ধান্ত বহাল রাখবেন না ভিএআরের রায় বলবৎ করবেন।
প্রযুক্তির এমন নিপুণ নজরদারি রেফারিকে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। তার প্রমাণও মিলেছে এবার। তবু বিতর্ক আর অসন্তোষ আছে। যেমন, ফিফার কাছে ক্ষোভ উগরে দিয়েছে সার্বিয়া। সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলায় পেনাল্টি দেওয়া হয়নি।
বিশ্বকাপ থেকে মরক্কোর বিদায়ের পর সে দেশের রয়্যাল ফুটবল ফেডারেশন রেফারি এবং ভিএআরের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে।
যে কোনো নতুন উদ্যোগে ভুলভ্রান্তি থাকবে, বিতর্ক বাধবে, ক্ষোভ-অসন্তোষ মাথাচাড়া দেবে, স্বাভাবিক। নতুন প্রয়াসের ভুল বার করা বা তাকে মেনে নিতে অনীহাও প্রত্যাশিত।
কিন্তু ইংল্যান্ডের ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের কথায়, আমার গোল বাতিল হওয়াতে আর দুঃখ নেই; আনন্দ এই, ওই একটা ঘটনার জেরে, ফুটবলের সার্বিক উন্নতির কথা ভেবে ফিফা গোললাইন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। বহু ভুল সিদ্ধান্তের ক্ষতি থেকে বেঁচে যাবে ফুটবল।