স্মার্টফোনে আসছে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক
শেখ আনোয়ার
🕐 ৯:৩৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০৪, ২০১৯
প্রবাদ আছে, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। এখন আর এই প্রবাদকে যৌক্তিকভাবে যথার্থ বলা যায় না। কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আমাদের আবেগকে অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছে আমাদের বিশ্বকে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দিন দিন আমাদের জীবনযাত্রা সহজ এবং আরামদায়ক করে দিচ্ছে। এতে কারও সন্দেহ থাকার মোটেও অবকাশ নেই। বলা যায়, সকাল থেকে রাত অবধি বিভিন্ন প্রযুক্তির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছি।
আমাদের সারা দিনের কর্মকাণ্ডে ডিজিটাল যেসব যন্ত্রপাতি একেবারে না হলেই নয়; তার মধ্যে অন্যতম হলো-অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, পিসি ও গেজেট। কী না করা যায় এসব ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে! দুনিয়া এখন সত্যি সত্যিই হাতের মুঠোয়। আর দুনিয়া হাতের মুঠোয় নিয়ে চলা যায় এমন সবচেয়ে ছোট্ট, পরিবহনযোগ্য মুঠোফোন-‘স্মার্টফোন’ আজ কতই না দরকারি। তাই তো ‘ফোরজি’ হতে বিশ্বব্যাপী ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে অত্যাধুনিক ‘ফাইভজি’ নেটওয়ার্কের আকাশ তরঙ্গের জয়-জয়কার ব্যবহার। এই ‘ফাইভজি’র বিচিত্র ব্যবহারের ব্যয় কমাতে; ব্যবহারে আরও সুবিধা বাড়াতে, ব্যয় সাশ্রয়ী ও সহজ লভ্যতার ব্যাপারে বিজ্ঞানী-গবেষকদের প্রচেষ্টা থেমে নেই।
সম্প্রতি মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটস এবং সেলুলার টেলিফোন সংস্থা সিটিসেলের স্বত্বাধিকারী ক্রেইগ ম্যাককাও যৌথভাবে চমকপ্রদ এক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন। তত্ত্বটা হচ্ছে মহাশূন্যের নিম্ন কক্ষপথে ব্যাপকভাবে ইন্টারনেট স্যাটেলাইট ছড়িয়ে দেওয়া। এখন গেটস-ম্যাককাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ভবিষ্যতে আরও ৮৪০টা স্যাটেলাইট মহাশূন্যে স্থাপন করবে। এসব স্যাটেলাইট প্রচলিত অপটিক্যাল অ্যানালগ মডেমের চেয়ে কমপক্ষে ৩৫ গুণ বেশি গতিতে ডাটা আদান প্রদান করবে বিশ্বের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। গেটস ও ম্যাককাও সে উদ্দেশ্যেই গঠন করেছে একটা জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। নাম দিয়েছে টেলিডেসিক।
অথচ কী আশ্চর্য! এক দশক আগেও কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞরা পরিহাস করতেন। পরিহাসের হাসি হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন : ‘ধুৎত্তুরি ছাই! এসব পরিকল্পনা কেবল পাগল-ছাগলদের মাথাতেই ঠাঁই পায়।’ সেসব পরিহাস এখন বিলীন হতে বসেছে। কারণ অতি সম্প্রতি বহুজাতিক কোম্পানি সিয়াটল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের অন্যতম বৃহৎ অংশীদার বোয়িং কোম্পানি বনাম টেলিডেসিকের মধ্যে প্রযুক্তিগত এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি মতে, বোয়িং কোম্পানি আগামী দশ বছরে ২২৮টা স্যাটেলাইট বানিয়ে স্থাপন করবে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে। এজন্য বোয়িংকে আরও ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। প্রকল্পটা যদি চালু হয় তাহলে গেটস-ম্যাককাও এবং বোয়িং প্রচ- লাভের জোয়ারে ভাসবে। অন্যদিকে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্র ও পরিধি আরও বেড়ে যাবে। আরও ছোট হয়ে আসবে পৃথিবী।
জি হ্যাঁ। কথাটা একদম ঠিক। হাইস্পিড মাল্টিমিডিয়া ভিডিও স্ট্রিমিং পদ্ধতি চালু হলে এক ডজনেরও বেশি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। কারণ নেট দুনিয়ায় ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তা বেড়েছে নেটফ্লিক্স-অ্যামাজন ও প্রাইমের মতো অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। সিসকো নেটওয়ার্ক তাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানায়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ইন্টারনেটভিত্তিক ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের পরিমাণ চারগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২৫ সালে পৃথিবীর সামগ্রিক ইন্টারনেট ট্রাফিকে ৮০ শতাংশ ডাটা ব্যবহৃত হবে এই কাজে।
ওদিকে গবেষকরা জানিয়েছেন, ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের সময় ভালো ছবির মানোন্নয়নে প্রতি ইঞ্চিতে বেশি পরিমাণ পিক্সেল দেওয়া হাই-ডেফিনিশন (এইচডি) ছবি তৈরি করতে যথেষ্ট শক্তিশালী পিসি ব্যবহৃত হয়। এজন্য অনেক বড় ডিজিটাল ফাইল নাড়াচাড়া করতে হয়। অনেক শক্তি ক্ষয়ের কাজ করতে হয় পরিসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে। সেই বড় ফাইলকে ওয়াইফাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বছর নিরবচ্ছিন্ন স্ট্রিমিং বজায় রেখে গ্রাহকসেবা দিতে আরও বেশি গতির ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহার করা দরকার হয় সেন্টারগুলোর। এই ডাটা সেন্টারগুলোর মধ্যে অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, প্রাইম, স্কাইব্রিজ, এমস্টার ও টেলিডেসিক তাই ব্যাপক আকারে নিম্ন কক্ষপথের নতুন এই স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে। এসব স্যাটেলাইট স্থাপন করা হবে পৃথিবী থেকে মাত্র কয়েকশ’ মাইল উপরে। উল্লেখ্য, বর্তমানে যেসব স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলো পৃথিবী থেকে বিশ বাইশ হাজার মাইল উপরে বিষুব রেখার চারপাশে নির্দিষ্ট পয়েন্টে অবস্থান করছে।
নতুন এই কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট দিয়ে কি লাভ হবে? এ ব্যাপারে গবেষকদের খোলামত : ‘নিম্ন কক্ষপথে স্যাটেলাইট স্থাপন করা মানেই কম শক্তি ব্যয় করা। আর কে না জানে, কম শক্তি ব্যয় করে ‘এইচডি’ সিগন্যালকে পৃথিবীর এক স্থান থেকে রিসিভ করে আরেক স্থানে প্রেরণ করা হবে এ সময়ের টেকসই, সবচেয়ে সহজ ও যুগপোযোগী দারুণ একটা কাজ। কারণ এর সুবিধাও রয়েছে অনেক।’
গবেষকরা খোলাসা করেন-‘নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইট চ্যানেলের জন্য বড় বড় ভয়ঙ্কর ভারী যন্ত্রপাতি দরকার নেই। ব্যবহারকারীদের কাছে ছোট্ট একটা ডিশ অ্যান্টেনা থাকলেই যথেষ্ট। এ প্রযুক্তিতে হাইস্পিড ইন্টারনেট, ডিশ ও টেলিফোন সিগন্যাল প্রেরণ ও রিসিভ করার মধ্যে সময়ের পার্থক্য বা হেরফের হবে মাত্র দুই সেকেন্ডের অল্প একটু কম। অথচ অবাক হলেও সত্যি, বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে সংযোগ পেতে সময় লাগে কুড়ি সেকেন্ড।’ কিন্তু এক্ষেত্রে একটা ছোট অসুবিধাও রয়েছে। যেমন, নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলোর পক্ষে বিশাল সব অঞ্চলকে স্ক্যান করা মোটেই সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সমাধান-ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের উপরে ভিন্ন ভিন্ন অনেক নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইট স্থাপন করার দরকার হবে।
যদিও এসব কাজে প্রচুর মেধা, শ্রম, অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হবে টেলিডেসিককে। তাই বিনিয়োগটা বেশি হলেও বেলা শেষে ব্যাপক লাভের প্রত্যাশা করছে কোম্পানি টেলিডেসিক। কারণ আগামী দিনে অল্প টাকার বিনিময়ে একমাত্র তারাই গ্রাহকদের হাতে তুলে দেবে রিমোটসহ স্মার্টফোন সাইজের শক্তিশালী ন্যানো যন্ত্র। গ্রাহকরা সঙ্গে পাবেন চায়ের কাপ পিরিচের-‘পিরিচ বাটি’র সমান আকৃতির মাইক্রো ডিশ অ্যান্টেনা। অ্যান্টেনাটা দেখতে গায়ে গতরে এত্তটুকুন হলে কী হবে! এই ন্যানো ডিশ অ্যান্টেনার মাধ্যমেই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে স্বাধীনভাবে সব হাইস্পিড নেটওয়ার্ক সহজে আসা-যাওয়ার কাজ করবে।
বর্তমানের মোবাইল ওয়াফাই ইন্টারনেট তখন অনেক সহজ ও সস্তা হয়ে যাবে। এই প্রযুক্তিতে ডাটা ব্যাংকের সঙ্গে সংক্ষিপ্ততম সময়ে যোগাযোগের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। বলা হয়ে থাকে, একটা উন্নয়নশীল দেশও টেলিডেসিকের একটা মাত্র নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বর্তমান যুগের বেশি দামের ইন্টারনেট ব্যবহারে বিরক্তিকর লো স্পিডের অবসান ঘটাতে সক্ষম হবে। কিন্তু হায় কপাল! এতসব গরম গরম সুবিধা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখায়নি। ‘ইরিডিয়াম’ নামের একটা কোম্পানি অবশ্য বিশ্বব্যাপী মোবাইল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সংস্থাটি নিম্ন কক্ষপথে এখন পর্যন্ত পাঁচটি স্যাটেলাইটও স্থাপন করতে পারেনি। তবে ইরিডিয়ামের মুখপাত্ররা শিগগিরই কাজগুলো সম্পন্ন করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
তাই এখন দারুণ ফুরফুরে টেলিডেসিকের গবেষকরা। তাদের বিশ্বাস : ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর চাহিদা বাড়বে শতগুণ।’ তাদের সমীক্ষা মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রচলিত স্মার্টফোনের গ্রাহক সংখ্যা হবে দেড়’শ কোটি। আর তখন মাত্র ছিয়ানব্বই কোটি মানুষ তাদের নিম্ন কক্ষপথের নতুন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করবে। সেদিন বেশি দূরে নয়, বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো অপ্রতিরোধ্য সাফল্যের অধিকারী উন্নয়নশীল ডিজিটাল নতুন এই বাংলাদেশে এরকম নিম্ন কক্ষপথের স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক হতে পারে হাইস্পিড টিভি, স্মার্টফোন ও গেজেটের জন্য একমাত্র সহজ ও ব্যয় সাশ্রয়ী জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম।
শেখ আনোয়ার
বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়