ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বায়ুদূষণ রোধে করণীয়

মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
🕐 ৮:২৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০১৯

বায়ু বা বাতাস হলো পরিবেশের অন্যতম ও প্রধান উপাদান। যা ছাড়া প্রাণিজগৎ এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। সে বাতাস আজ শুধু দূষিত নয়, জীবনহানির মতো ভয়াবহ কারণ। যেটি জীবন বাঁচায়, সেটি আজ জীবনহানির অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে। গত ৬ মার্চ ২০১৯ বুধবারে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রীনপিস এবং এয়ারভিজুয়াল জানিয়েছে, ২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম এক নম্বরে রয়েছে। আর সেটা হয়েছে আর হয়েছে বা হচ্ছে আমদের কারণেই। আমরাই এর জন্য শতভাগ দায়ী।

বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হলো নিউক্লীয় আবর্জনা, কয়লা পুড়িয়ে ধোঁয়া ও গন্ধ বাতাসে মিশে বাতাস দূষিত হচ্ছে। দূষণের ফলে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হতে হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণ বলছে, বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর বস্তুকণা, ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শহরের বাতাসে ক্ষতিকর ওই তিন উপাদানের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি থাকে।

বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা ‘স্টেট অফ গ্লোবাল এয়ার’ এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন না কোনোভাবে বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ দূষিত এলাকায় বাস করে। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার মানুষ আর ভারত ও চীনে মারা যাচ্ছে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বায়ুদূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। বায়ুদূষণের স্বীকার হয়ে যে দশটি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে, সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। সংস্থাটি বলছে, সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায় দূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।

বাংলাদেশে পরিবেশ সমীক্ষা-শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার চারপাশে প্রায় হাজার খানেক ইটভাটা প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে চালু হয়। সেগুলো এই বায়ুদূষণের জন্য ৫৮ শতাংশ দায়ী। এর বাইরে রোড ও সয়েল ডাস্টের জন্য ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, জৈববস্তু পোড়ানো ৮ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ রয়েছে। ঢাকা শহরে শুধু গাড়ির ধোঁয়া থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার ৭০০ টন সূক্ষ্ম বস্তুকণা প্রতিনিয়ত বাতাসে ছড়াচ্ছে।

বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নারী ও শিশুরা। চিকিৎসকরা বলছেন, সূক্ষ্মকণার মাত্রা ২.৫ হলে তা ফুসফুস পর্যন্ত প্রবেশ করে আর মাত্রা ১০ হলে সেটি শ্বাসনালিতে আক্রমণ করে। বাতাসে এ সূক্ষ্মকণার মাত্রা বাড়ার ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের সর্দি, কাশি, হাঁপানি, এলার্জি এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোঅক্সাইড বেড়ে যাওয়াতে ফুসফুসে ক্যান্সারও হতে পারে। বাতাসে ভাসতে থাকা সীসা শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নসহ নানা কারণে ঢাকার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিষ। বিষ ছড়ানো দূষিত বাতাসের কারণে অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ জটিল ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বিশ্বব্যাংকের রেফারেন্স দিয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশ এক বছরে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশনের বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় জানা গেছে, বায়ুদূষণের কারণে সাত লক্ষাধিক মানুষ শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছে। কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, ব্রঙ্কাইটিস, কিডনির জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডও সীসার কারণে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস হতে পারে।

এক জরিপে উঠে এসেছে, যেসব শিশু বস্তিতে কিংবা রাস্তার পাশে বেড়ে ওঠে তারা মাত্রাতিরিক্ত সীসা দূষণের শিকার হয়। আর এই সীসা দূষণের কারণে শিশুরা রক্তশূন্যতায় ভোগে। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের মেধা বিকশিত হয় না ঠিকমতো, যার কারণে তারা জাতি গঠনেও ঠিকমতো ভূমিকা রাখতে পারে না। বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় প্রভাব গিয়ে পড়ে একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতি। দূষিত বায়ুর প্রভাবে তার গর্ভে থাকা শিশুটি আক্রান্ত হয়।

বাতাসে যদি মাত্রাতিরিক্ত সীসার অবস্থান থাকে সেটা একজন গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভের সন্তানকে মারাত্মকভাবে সারা জীবনের জন্য আক্রান্ত করে। কোনো গর্ভবতী নারী যদি দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের শিকার হন, তাহলে ক্রমাগত তারা অক্সিজেনের ঘাটতিতে থাকবেন, তারা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ) তে আক্রান্ত রোগী হবেন। আর এর ফলে তার গর্ভে থাকা সন্তানটি অপরিণত নবজাতক হিসেবে জন্ম নেবে।

ডায়াবেটিস বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বাড়তে থাকে থাকা রোগগুলোর একটি। বিশ্বে প্রায় ৪২ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক নতুন গবেষণায় বলা হচ্ছে, বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিস ঝুঁকি বাড়ার বেশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০১৬ সালে বিশ্বে প্রতি সাতটি নতুন ডায়াবেটিস কেসের একটির পেছনে আছে ঘরের বাইরের বায়ুদূষণ। সে বছর বিশ্বে শুধু বায়ুদূষণের কারণে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত একজন বিজ্ঞানী জিয়াদ আল আলি বলছেন, ডায়াবেটিসের সঙ্গে বায়ুদূষণের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখতে পারছেন তারা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে শরীরের ইনসুলিন কমে যায়। এর ফলে ব্লাড গ্লুকোজকে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে না আমাদের শরীর। চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা যৌথ গবেষণার মাধ্যমে জানিয়েছেন, তীব্র বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের বুদ্ধি কমে যাওয়ার সম্পর্ক আছে।

পরিকল্পনার অভাবে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা থাকবে, তবে তা সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা নিতে হবে। নগরের আশপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণে জোর দিতে হবে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে খুঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে সকাল-দুপুর- বিকালে অন্তত তিন দফা নির্মাণাধীন রাস্তাঘাটে পানি ছিটাতে হবে। প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তায় বালি, মাটিসহ নানা ধরনের সামগ্রী পরিবহনের সময় মালামাল ঢেকে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়ে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে বাড়ি, কারখানা, গাড়ি থেকে ধোঁয়া নিঃসরণ কম করার চেষ্টা করতে হবে। আতসবাজি ব্যবহার করবেন না। আবর্জনা বা জঞ্জাল ডাস্টবিনে ফেলতে হবে, পোড়ানো যাবে না। থুতু ফেলার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে এবং থুতু নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। সবাইকে বায়ুদূষণ সংক্রান্ত সমস্ত আইন মেনে চলতে হবে।

এই বায়ুদূষণ আমাদের জীবনে এমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে যে খুব দ্রত যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা না করা যায় তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অসুস্থ প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠবে। এই কাজে সফল না হলে ২০৫০ সালে গোটা বিশ্বে বায়ুদূষণের ফলে প্রায় ৬০ লাখেরও বেশি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটবে। শুধু এশিয়ায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে। বায়ুদূষণ যতই বাড়বে ততই আমাদের পক্ষে বিশুদ্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। বায়ুদূষণ ভবিষ্যৎ মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দাঁড়াবে। মানুষই বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তাই মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে বায়ুদূষণ কমিয়ে আগামী দিনের মানুষের জন্য পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যাওয়া।

মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
কলাম লেখক

 
Electronic Paper