নারীর ক্ষমতায়নে ‘তথ্য আপা’
শামীম সিকদার
🕐 ৯:৪৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৭, ২০১৯
ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। সর্বত্রই লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। সব কার্যক্রমেই দেখা যাচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার। কৃষক মাঠে বসেই স্মার্টফোনের মাধ্যমে পাচ্ছেন কৃষি-সংক্রান্ত সেবা ও পরামর্শ। প্রত্যন্ত পল্লীর নববধূ স্কাইপে কথা বলছেন তার প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে। সরকারের প্রায় সব নাগরিক সেবা হয়েছে ডিজিটালাইজড।
তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর এসব কার্যক্রমে সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা কম সুবিধাপ্রাপ্ত নারীর প্রবেশাধিকার এবং তাদের তথ্যপ্রযুক্তির সেবা প্রদানের লক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থা ‘তথ্য আপা’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে।
এই প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ৪৯০টি উপজেলায় একটি করে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে ডোর টু ডোর তথ্যসেবা, উঠান বৈঠক, মুক্ত আলোচনা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রতিটি তথ্যকেন্দ্রে একজন তথ্যসেবা কর্মকর্তা ও দুইজন তথ্যসেবা সহকারী নিয়োজিত আছেন।
এরাই গ্রামীণ নারীদের কাছে ‘তথ্য আপা’ হিসেবে পরিচিত। তথ্য আপারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, উপজেলার সরকারি সেবাগুলোর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, ভিডিও কনফারেন্স, ই-লার্নিং, ই-কমার্স ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন। এছাড়া তথ্য আপারা ল্যাপটপ ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রকল্পের আওতাধীন সেবা গ্রহিতার বাড়িতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, ব্যবসা, জেন্ডার এবং কৃষিবিষয়ক বিভিন্ন তথ্যসেবা প্রদান করছেন।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট- এসডিজির ৫ নম্বর অভীষ্ট, বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন দেশের সার্বিক অগ্রগতির অন্যতম শর্ত। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষতা বাড়াতে তথ্য আপা প্রকল্প তাই সময়োপযোগী এক পদক্ষেপ।
এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ১৩টি তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩২৯ নারীকে তথ্যসেবা প্রদান করা হয়। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে ২৫ হাজার ৩২৩ জন গ্রামীণ মহিলাকে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক কার্যক্রমে সচেতন করা হয়। ওয়েব পোর্টাল, তথ্য ভাণ্ডার, উইমেন টিভি, এমআইএস সফটওয়্যার, মোবাইল এপ্লিকেশন এবং কল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজে সফলতা অর্জন হওয়ায় এর ধারাবাহিকতায় দেশের ৫৯০টি উপজেলায় তৃণমূল নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে।
উপজেলা পর্যায়ে স্থাপিত তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে তথ্যসেবা প্রদানের পাশাপাশি সেবা গ্রহিতাদের জন্য উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গ্রামীণ তৃণমূল মহিলাদের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সমাধান করার চেষ্টা করা হয়। যেমন : স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বাল্যবিয়ে, ফতোয়া, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, চাকরি সংক্রান্ত তথ্য, আইনগত সমস্যা এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। ডিজিটাল সেবাগুলোর বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে অবহিত করার জন্য উঠান বৈঠক, মুক্ত আলোচনা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
প্রতিটি উঠান বৈঠকে ৫০ জন গ্রামীণ মহিলা অংশগ্রহণ করে থাকেন। মাসে প্রতিটি তথ্যকেন্দ্র দুটি করে উঠান বৈঠকের আয়োজন করে থাকে। ইউএনও, কৃষি, শিক্ষা, মৎস্য, স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি আইসিটি বিশেষজ্ঞ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিসোর্স পারসন হিসেবে উঠান বৈঠকে উপস্থিত থেকে আলোচনা করে থাকেন। এছাড়া স্থানীয় নারী উদ্যোক্তা, নারী আইনজ্ঞ, সমাজসেবী, সাংবাদিক, সমাজের নেতৃত্বদানকারী মহিলারাও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, যৌতুক নিরোধ আইন, পারিবারিক সহিংসতা এবং নারীনীতি সম্পর্কে মুক্ত আলোচনা করেন।
তথ্যসেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীদের বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার ও ওয়েবসাইট ব্রাউজ সম্পর্কে সচেতন করা হয়। এ ছাড়াও স্কাইপে কথা বলা, পরীক্ষার ফলাফল দেখা, চাকরি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা, সরকারি সেবা সম্পর্কে অবহিত করা, সরকারি সেবা প্রদানকারী অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেবা প্রদান নিশ্চিত করা হয়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে গ্রামীণ মহিলাদের সচেতন করা হয়। সেবাকেন্দ্র থেকে বিনামূল্যে ওজন মাপা, প্রেশার মাপা ও ডায়াবেটিস মাপা হয়। এ ছাড়াও তথ্যকেন্দ্রে মহিলা সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু, অভিযোগ, মতামত, স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদির রেকর্ড রেখে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সংক্রান্ত রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করা হয় এসব তথ্যকেন্দ্রে।
প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ে একটি সমৃদ্ধ তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছে। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য এ প্রকল্প গ্রামীণ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত নারীগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা কিছুটা দক্ষতাসম্পন্ন এবং যাদের মধ্যে উদ্যোগী মনোভাব বিদ্যমান, তারাই হচ্ছেন তথ্য ভাণ্ডারের প্রধান সেবা-গ্রহীতা। তবে সাধারণভাবে তথ্য ভাণ্ডারের সেবা সব নারীর জন্যই প্রযোজ্য। স্বাস্থ্য সুরক্ষা-বিষয়ক তথ্য, রান্না-বিষয়ক অথবা দৈনন্দিন জীবনের নানা দরকারি তথ্য, প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা, শিশু-বিষয়ক নানা তথ্য, চাকরি অনুসন্ধান ইত্যাদি সব ধরনের তথ্যের জন্য এই নারীগোষ্ঠীর সামনে তথ্য ভাণ্ডারের দুয়ার থাকছে খোলা।
প্রকল্পের ওয়েব পোর্টালের মূল উপজীব্য হলো নারী। নারী সম্পর্কিত নানা ঘটনা, বিষয়াবলী, নারী নীতি এবং নারীকেন্দ্রিক তথ্য প্রবাহ এ সবই এই ওয়েব পোর্টালের মুখ্য বিষয়। বাংলা ও ইংরেজিতে তৈরি এ ওয়েব পোর্টালের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে তথ্য ভাণ্ডার এবং আইপি টিভি। ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে নারী-বিষয়ক বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, তাদের কর্মসূচি ও কার্যক্রমের পরিধি সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আরও রয়েছে ব্লগিং ও অনলাইন আবেদনপত্র পেশসহ বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগের ব্যবস্থা।
প্রকল্পের মেয়াদ শেষে প্রকল্পের আউটপুট জাতীয় মহিলা সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। তথ্য আপা প্রকল্পের প্রধান কার্যালয়ের অনলাইন কার্যক্রমগুলো, ওয়েব পোর্টাল, তথ্য ভাণ্ডার, তথ্য আপা, আইপি টিভি, এমআইএস সফটওয়্যার ও কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি জাতীয় মহিলা সংস্থার হেফাজতে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। প্রকল্প শেষে এসব অনলাইন কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত হবে।
এক্ষেত্রে প্রয়োজনে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি নিয়ে পদ সৃষ্টি করা হবে। প্রকল্প মেয়াদ শেষে তথ্য আপা প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা ও উপজেলা অফিসের মাধ্যমে অব্যাহত রাখা হবে। বর্তমানে ৬৪টি জেলা এবং ৫০টি উপজেলায় জাতীয় মহিলা সংস্থার অফিস রয়েছে। অবশিষ্ট উপজেলায় জাতীয় মহিলা সংস্থার অফিস প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। প্রকল্পের সাসটেইনেবিলিটি নিশ্চিতকরণে মাইন্ড ইন্সপায়ার টু ন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট দল গঠন এবং ই-লার্নিং-এর মাধ্যমে উদ্যোগী মহিলাদের বিশেষভাবে গড়ে তোলার পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হবে।
পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ নারীদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করা এবং তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক ডিভাইসের ব্যবহার সম্পর্কে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য তথ্য আপা প্রকল্প কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী, যাদের অধিকাংশই বসবাস করেন গ্রামে। গ্রামের নারীরা এখনো মূল স্রোত থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছেন। তাই এসব নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে নিয়ে আসার জন্যই তথ্য আপা প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ টেকসই ও মজবুত হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
শামীম সিকদার: শিক্ষক ও কলামিষ্ট
[email protected]