আবরার হত্যা ও রাজনৈতিক ভুল
মোহাম্মদ নূরুল হক
🕐 ৯:৩০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর নিষ্ক্রিয় বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর পালে যেন নতুন হাওয়া লেগেছে। এসব দলের নেতাদের অভিযোগ, ভারতের সঙ্গে ‘দেশবিরোধী চুক্তি’র বিরোধিতা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায়ই ছাত্রলীগ নেতারা আবরারকে হত্যা করেছে।
এই নেতাদের পাশাপাশি কোনো কোনো সাংবাদিকও তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জের ছাত্রলীগ নেতারা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অর্থাৎ বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে এসব সাংবাদিকও একমত পোষণ করেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, আবরারের ‘ফেসবুক পোস্টের জের’ ধরেই তাকে হত্যা করা হয়েছে কি না?
এই প্রশ্নের উত্তর বের করার আগে ফেসবুক পোস্ট, পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডের সময় বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত। আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িতদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের একটি স্ক্রিনশট ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই স্ক্রিনশট বলছে, ঘটনার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা আসে শনিবার (৫ অক্টোবর)।
ওই নির্দেশনায় দেখা যায়, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবীন ওইদিন দুপুর ১২টা ৪৭ মিনিটে গ্রুপে লিখেছে, ‘১৭-র আবরার ফাহাদকে মেরে হল থেকে বের করে দিবি দ্রুত। এর আগেও বলেছিলাম, তোদের তো দেখি কোনো বিকার নেই। শিবির চেক দিতে বলেছিলাম।’
জবাবে ‘ওকে ভাই’ বলে নির্দেশনা পালন করার অঙ্গীকার করে হত্যা মামলার আসামি মনিরুজ্জামান। এরপর মেহেদী তাদের দুদিনের সময় দেয়। কিছুক্ষণ পর আবরামের রুমমেট মিজানুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্যও মনিরুজ্জানকে নির্দেশ দেয় মেহেদী।
ওই নির্দেশনার পর শনিবার আবরারের সঙ্গে আসামিদের কোনো বাকবিতণ্ডা হয়নি। তবে, হত্যাকারীরা যখন আবরারকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল, ওই সময় আবরার হয়তো ভাবছিলেন অন্য কিছু বিষয়ে। তবে কী কী বিষয়ে নিয়ে ভাবছিলেন, তা জানা না গেলেও ওই দিন বিকাল ৫টায় তার ফেসবুক টাইমলাইনে দেওয়া একটি পোস্ট বলছে, তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চুক্তিবিরোধী ছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভারতের কাছে কলকাতাবন্দর ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে হতাশ হয়েছিলে বলে উল্লেখ করে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এরপরই স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে ভারতের জন্য মোংলা বন্দর খুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে উল্লেখ করেছেন, ‘ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দরই ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।’
এরপর তুলে ধরেছেন নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত দরকষাকষি প্রসঙ্গে। কাবেরি নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কানাডি ও তামিলদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, বাংলাদেশ কেন কোনো ধরনের ‘বিনিময় ছাড়াই দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি’ দেবে? ওই পোস্টের তৃতীয় দফায় ভারতকে গ্যাস দেওয়ার বিপক্ষে নিজের অভিমত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাবো।’
শনিবার (৫ অক্টোবর) ওই পোস্ট দেওয়ার পর থেকে পরদিন রোববার (৬ অক্টোবর) রাত ৮টার আগ পর্যন্ত আবরারের সঙ্গে হত্যাকারীদের কোনো কথা কাটাকাটি কিংবা ঝগড়া-ঝাটি কিছুই হয়নি। তবে, সন্ধ্যা ৭টা ৫২ মিনিট থেকে রাত ১টা ২৬ মিনিট পর্যন্ত হত্যাকারীদের নিজেদের মধ্যে যে কথোপকথন হয়, তাতে দেখা যায়, তারা আবরারকে মারধর করে হত্যা করেছে। নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময়ই তারা একজন আরেকজনকে বলছে, বেশি মারার কারণেই আবরারের মৃত্যু হয়েছে।
এই হলো, আবরার হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনার সারাংশ। মারধরের নির্দেশনা, আবরারের ফেসবুক পোস্ট এবং সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে কোনোভাবেই একথা বলা যায় না যে, গত ৫ অক্টোবরের ফেসবুক পোস্টের জের ধরে আবহারকে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি এখন পর্যন্ত মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কথায় কিংবা আদালতে আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোথাও ফেসবুক পোস্টের কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়নি। অথচ বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি কিছু সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীও বলছেন, আবরারকে হত্যা করা হয়েছে ‘ফেসবুকে ভারতবিরোধী পোস্ট’ দেওয়ার কারণে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্ন সামনে আসে। সেগুলো হলো-
১। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আবরারের ভারতবিরোধী পোস্টকে কারণ হিসেবে দেখার উদ্দেশ্য কী?
২। কীসের ভিত্তিতে রাজনৈতিক নেতারা বলছেন ভারতবিরোধী পোস্টের কারণেই আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে?
৩। সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন?
পুনরুক্তি এড়িয়ে চলাসহ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের সুবিধার্থে তিনটি ইস্যুই একত্রে আলোচনা করা যাক। আগেই বলা হয়েছে, আবরারের ফেসবুক পোস্টের প্রায় ৫ ঘণ্টা আগেই তাকে মেরে হল থেকে বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ছাত্রলীগ নেতারা। সেই অনুযায়ী তারা অনুসারীদের নির্দেশনাও দেয়।
আবরার হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার ভারতবিরোধী মনোভাবকে কারণ হিসেবে দেখার উদ্দেশ্য আছে বিএনপি কিংবা সমমনা দলগুলোর নেতাদের। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম বিকল্পে ন্যূনতম সভা-সমাবেশ করার জন্য হলেও একটি ইস্যুর প্রয়োজন ছিল তাদের। কারণ এর আগে ক্যাসিনো-দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে একের পর এক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেরই সহযোগী সংগঠন যুবলীগ নেতাদেরই গ্রেফতার-আটক করা হচ্ছিল।
কেবল রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণেই ওই অভিযানকে সাধুবাদ জানাতে পারেনি বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। পরন্তু ওই গ্রেফতার-আটককে ‘আইওয়াশ’, ‘লোক দেখানো’ ও ‘রাঘববোয়াল বাদ দিয়ে চুনোপুঁটি ধরার অভিযান’ বলেও অভিহিত করেছেন তারা। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে দেওয়া তাদের বক্তব্যের সারাংশ করলে দেখা যাবে, তাদের দাবি মূলত একটিই।
সরকারের পতন ও নতুন নির্বাচন। কিন্তু সরকারের পতন কেন হতে হবে এবং নতুন নির্বাচনই বা কেন দিতে হবে, তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বিএনপি কিংবা সমমনা দলগুলো দেখাতে পারেনি।
সরকার পতনের আন্দোলন অনেক দূরের বিষয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলো নিজেরাই কোনো একটি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া পারছে না। পরন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে গেছে। ফলে এসব রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো ইস্যু না পেয়ে ‘ড্রয়িংরুম রাজনীতি’-‘বিবৃতিনির্ভর রাজনীতি’ চর্চার নিমগ্ন ছিল।
আবরার হত্যাকাণ্ড যেন হঠাৎ করেই এই দলগুলোর রাজনীতির পালে হাওয়া লাগালো। কিন্তু সেই হাওয়ায় পাল তুলে নৌকা বাইতে যাওয়ার জন্য যে ধরনের মাঝি-মাল্লা ও দড়ি-কাছি নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, এই দলগুলো তা পারেনি। উল্টো এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আবরারের ভারতবিরোধী মনোভাব খোঁজার পেছনে সময় ব্যয় করে চলেছে। তবে, এই ধরনের দাবির পেছনে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর নেতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটি হলো, আবরারকে দেশপ্রেমিক আখ্যায়িত করা। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা যে কোনো চুক্তিতে দেশপ্রেমিক নাগরিকের সম্মতি নেই বলে দাবি করা। আর তাদের এই দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে জনগণের একটি অংশের সমর্থন হয়তো বিএনপি পেতে পারে।
গভীর জঙ্গলে দিগভ্রান্ত পথিক যেমন হঠাৎ পাতার ফাঁকে এক চিলতে আলোর ঝিলিক দেখে বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তেমনি এমন একটি ক্ষীণ আশা জাগতেও পারে দলটির নেতাদের মনে। প্রায় ডুবন্ত একটি দল রাজনীতির মাঠ গরম করার মতো অন্তত মিছিল-সভা-সমাবেশ করার একটি ইস্যু পেয়ে গেল। তাই তারা বারবারই আবরার হত্যার পেছনে তার ভারতবিরোধী মনোভাবের কথা উল্লেখ করছেন। একই সঙ্গে তাকে শহীদ আখ্যা দেওয়ার পাশাপাশি তার নামে ফেনী নদীর নামকরণেরও প্রস্তাব দেন তারা। কিন্তু তাদের সেই আন্দোলন-দাবির সঙ্গে দেশের জনগণ এমনকি খোদ বুয়েট-ছাত্রদেরই একাত্মতা ঘোষণা করতে দেখা গেলো না।
অথচ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কিছু সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীও। তারা বলছে, ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণেই আবরারকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আবরারের ফেসবুক পোস্ট ও হত্যাকারীদের পরিকল্পনা-নির্দেশনার সময় মিলিয়ে দেখলে এসব রাজনৈতিক নেতা-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো, রাজনীতিবিদরা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য হয়তো এমন অভিযোগ তুলছেন। সেখানে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে।
সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক-স্বার্থ-সংঘাত থাকতেই পারে। তা নিয়ে পরস্পরের প্রতি দোষারোপও চলতে পারে। কিন্তু সংবাদকর্মী ও বুদ্ধিজীবীরা কোন স্বার্থে, কোন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ‘ভারতবিরোধী ফেসবুক পোস্টের জের ধরে’ আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে দাবি করছেন? সংবাদের প্রাণ যে বস্তুনিষ্ঠ ‘তথ্য ও তথ্যসূত্র’ সেই অপরিহার্য শর্তটি কোন স্বার্থের কাছে তারা জলাঞ্জলি দিয়েছেন? আর বুদ্ধিজীবী-কলামিস্টরা ভরসা করছেন কোন সূত্রের ওপর?
অবস্থাদৃষ্টে মনে পড়ে গেলো, জ্ঞান-প্রজ্ঞা-যুক্তিনিষ্ঠ তথ্যভাণ্ডার সসীম, গোঁয়ার্তুমি-অজ্ঞতা অসীম। সমাজে এখন অজ্ঞতা-গোঁয়ার্তুমির দৌরাত্ম্য চলছে?
মোহাম্মদ নূরুল হক
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক