ধর্মান্ধতাই সম্প্রীতি রক্ষার অন্তরায়
জামাল আস সাবেত
🕐 ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০১৯
এত রক্ত, এত বিষ, এত কান্না, এত হাহাকার, এত বিদ্বেষ! কখন যেন মানুষের মনের ভেতরে এত বড় একটা দেয়াল সৃষ্টি হয়ে গেল! অথচ মানুষ টেরই পেল না? একে অন্যে গালাগালি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হরহামেশা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির- এসব বন্ধ হবে কবে? কোনোকালেই আল্লাহ ভগবান ঈশ্বরের রক্ত ঝরে না, রক্ত ঝরে সাধারণের। বুক খালি হয় আমার, আপনার মায়ের।
সমাজে আল্লাহ ভগবান ঈশ্বরের ভিন্ন-ভিন্ন দেয়াল দাঁড় করিয়েছি আমরা। কোন আল্লাহ কোন ভগবান বলেছেন ভিন্ন-ভিন্ন দেয়াল তৈরি করতে? কোন কিতাবের কোন লাইনে বলা আছে, বড় বড় দেয়াল তৈরি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দিতে?
স্বামী বিবেকানন্দের ‘সখার প্রতি’ কবিতার অন্তিম দুটি চরণ- ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ এই যে মানুষগুলো মরল, এরা কি জীবের মধ্যে নয়? কোথায় লেখা আছে, উসকানি দিয়ে মানুষ মারো? ঈশ্বরের ধর্ম তো খুনোখুনি নয়, ঈশ্বরের ধর্ম ‘সেবা’। ধর্ম পালন করে যদি বিবেক বিবশ হয়ে যায়, তাহলে ও-ধর্ম তার জন্য নয়।
মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডিদাস উচ্চারণ করেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ এই চিরন্তন বাণী যে অনুসরণ করেনি, সে-ই হয়ে উঠে মানুষরূপী ধর্মান্ধ। চলার পথে যে মানুষ সে মানুষ দেখে, যে ধর্মান্ধ সে শত্রু দেখে। জানা নেই, শোনা নেই, অধ্যয়ন নেই, চর্চা নেই সে-ই আবার ধর্মানুসারী দাবি করে! এসব লোক কেবল মানুষেরই শত্রু না, ধর্মেরও শত্রু।
আল্লাহ ভগবান ঈশ্বর কে? এই পরিচয় কয়জন জানে? সবাই ভাবে, তার পূজা করতে হবে, তার কাছে প্রার্থনা করতে হবে, তার ইবাদত করতে হবে; কিন্তু তাকে যে চিনতে হবে এ কথা কয়জন ভাবেন? তাকে চেনার মধ্যেও যে বড় পুণ্য রয়েছে, এ চিন্তা কয়জন ধর্মান্ধের মনে উঁকি দেয়? কেবল অন্যের ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করে, অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে নিজের ধর্মকে, নিজেকে বড় করা যায় না। বড় হওয়ার একটাই উপায়, সেবা করা। সেবা ঈশ্বরের ধর্ম। ঈশ্বরের ধর্মের চিন্তা মাথায় রেখে বাকি তোমার ধর্ম নিয়ে ভাব। তোমার ধর্ম পালন কর। তাহলেই তোমার ধর্মের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারবে। ঈশ্বরের ধর্ম আর তোমার ধর্ম যদি এক না হয়, তখনই তুমি হিংস্র এবং সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে।
ধর্মটাকে কেবল বিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে, জানার মধ্যে আবদ্ধ করতে পারেনি। ধর্মান্ধ হওয়ার এটাই ভয়ঙ্কর রাস্তা। ধর্মান্ধরা কেবল পূজা করতে পারে, ভগবানের ঘরে নতজানু হতে পারে, কিন্তু ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে বুকে টেনে নিতে পারে না।
মানুষের রক্ত ঝরাতে ঝরাতে আজ ধর্মকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। এ জন্যই হুমায়ুন আজাদ বলছিলেন, ‘মসজিদ ভাঙে ধার্মিকরা, মন্দিরও ভাঙে ধার্মিকরা- তারপরও তারা দাবি করে তারা ধার্মিক আর যারা ভাঙাভাঙিতে নেই তারা অধার্মিক বা নাস্তিক।’ হুমায়ুন আজাদ এখানে ধার্মিক শব্দ ব্যবহার না করে, ধর্মান্ধ বা উগ্রবাদ ব্যবহার করলে যথোপযুক্ত ছিল।
অনলাইন বা সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আনা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা কিছু ছড়িয়ে দিলে, পুরো জাতি তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে এখন সোশ্যাল মিডিয়া সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়ায় উগ্রপন্থিদের আনাগোনা বা তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে না আনলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কখনোই বন্ধ হবে না।
জামাল আস সাবেত : লেখক ও কলামিস্ট
[email protected]