ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জবির সমৃদ্ধির চতুর্দশ বর্ষপূর্তি

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
🕐 ৯:৪০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০১৯

চতুর্দশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সব সদস্যকে জানাই আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ১৪ বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট সময় নয়। তারপরও স্বল্প সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি অর্জন এবং মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততাসহ অনেক ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধন করেছে। এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োজিত শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এক্ষেত্রে বর্তমান সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দাতাগোষ্ঠীসহ অনেকেই সহযোগিতা করেছে। তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা করছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক ও মানসম্মত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের ক্ষেত্রে আগামী দিনেও সবার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর ‘জগন্নাথ কলেজ’কে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট একেবারই ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যথাযথ পরিবেশ এবং সংস্কৃতি নিশ্চিত না করেই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দেওয়া হয়। তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষকরা মামলা-মোকদ্দমার মধ্য দিয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ফলে ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় নামটিই শুধু প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। এ অর্থে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স মূলত ৯ বছর। প্রথম কয়েক বছর কলেজের সংস্কৃতিই বিরাজমান ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ নতুন নতুন জ্ঞান তৈরি, বিতরণ এবং প্রদান করার কোনো ব্যবস্থাই তখন ছিল না।  

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বড় একটি সমস্যা ছিল। তৎকালীন সরকার ২০০৫-এ পাসকৃত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২৭ (৪) ধারার মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানটি অনুমোদন করে। ২০১১ সালে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলে সেই কালো ধারাটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাতিল করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য- কলেজে শুধু পাঠদান অর্থাৎ জ্ঞান বিতরণ করা হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল জ্ঞান বিতরণ নয়, জ্ঞান-অনুসন্ধান ও আহরণ করা হয়। জ্ঞান আহরণের বিষয়টা একান্তই গবেষণার ওপর নির্ভরশীল। ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে এখানে এমফিল-পিএইচ.ডি প্রোগ্রাম চালু হয়। অর্থাৎ বর্তমানে আমরা একাডেমিক গবেষণার সপ্তম বছরে। শিক্ষকরা এমফিল-পিএইচ.ডি গবেষকদের তত্ত্বাবধান করছেন। এ কারণে শিক্ষকরা গবেষণাকর্মে আগের থেকে অনেকটা উদ্যোগী। গত সাতটি শিক্ষাবর্ষে এমফিল ডিগ্রিতে গবেষকের সংখ্যা ২১৪ জন এবং পিএইচ.ডি ডিগ্রিতে গবেষকের সংখ্যা ৮৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গবেষক ইতোমধ্যে তাদের এমফিল-পিএইচ.ডি গবেষণা সম্পন্ন করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ক’টি বিভাগের কোনো না কোনো শিক্ষক বিভিন্ন গবেষণায় নিয়োজিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এবং ইউজিসির অর্থায়নে বর্তমানে প্রায় ১৬০ জন শিক্ষক গবেষণা করছেন। আমাদের নিজস্ব গবেষণা ও প্রকাশনা বলতে পূর্বে তেমন কিছু ছিল না, শুধু কিছু জার্নাল প্রকাশিত হতো। ইতোমধ্যে জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর থেকে ১০টি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং আগামী বইমেলার আগে আরও ১৫-১৬টি বইয়ের মুদ্রণ সম্পন্ন হবে। গত দুই বছর ধরে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্টলে আমাদের প্রকাশিত এবং শিক্ষকদের প্রকাশিত বই এবং অন্যান্য প্রকাশনা দিয়ে স্টল দেওয়া হচ্ছে। আগামী বইমেলায় আমাদের নিজস্ব প্রকাশনায় ২৫টির অধিক গবেষণাধর্মী বই পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশের একটি বড় পরিবর্তন।
বাংলাদেশে এটিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অধ্যাপক পদে যারা রয়েছেন তারা ২-৩ জন ছাড়া সবাই পিএইচ.ডি ডিগ্রিধারী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিমালা করা হয়েছে, আগামী ২০২০ সালের জুনের পর পিএইচ.ডি ডিগ্রি ছাড়া কোনো শিক্ষক অধ্যাপক হতে পারবেন না। এই নীতিমালা বাংলাদেশে একমাত্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম করা হয়েছে। একসময় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন বিভাগে সেশনজট লেগেই থাকত; যেটা বর্তমান সময়ে আমরা পুরোটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। প্রতি বছরই কেন্দ্রীয়ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয় কোন সেমিস্টারের পরীক্ষাগুলো কবে শেষ করতে হবে এবং সেমিস্টারের ক্লাসগুলো কবে শুরু হবে। এসব গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং করার ফলে এখন সেশনজট নেই বললেই চলে।

শূন্য আবাসনের বিশ্ববিদ্যালয়টি শীঘ্রই বাংলাবাজারে নির্মিত ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’-এর উদ্বোধন করে নারী শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গার সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল প্রকল্পের অধীনে ২০ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ১৬ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ শেষে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ফিনিশিংয়ের কাজ। হলটি উদ্বোধন হলে এক হাজার ছাত্রীর আবাসন ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের campus network প্রকল্পের মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড আইটি দফতরের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি বিভাগ এবং দফতরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করার জন্য ফাইবার অপটিক কেবলের সাহায্যে একটি ব্যাকবোন নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা ডরঋর-এর মাধ্যমে তারবিহীন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেবাখাতের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবহন। পাঁচ বছর আগেও পরিবহনের জন্য সীমিতসংখ্যক যানবাহন ছিল যেখানে বর্তমানে ৫০টির মতো যানবাহন পরিবহন পুলে বিদ্যমান। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অধিকতর পরিবহন সুবিধা দেওয়ার জন্য বিআরটিসি থেকে ভাড়া করা বাসের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য নতুন ক্রয়কৃত ১০টি বাস বিভিন্ন রুটে চালু করার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে। বিশ^বিদ্যালয়ের একমাত্র ক্যান্টিনটি সংস্কার করে আধুনিক ক্যাফেটরিয়ায় রূপান্তর করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবা সম্প্রসারিত হয়ে বর্তমানে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১০টি শাখার মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। উপরন্তু এখন এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক ডিজিটাল গ্রন্থাগার রূপে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। প্রায় ৬০টি ল্যাপটপের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ই-বুকস ও অনলাইন জার্নাল সেবা চালু রয়েছে।

বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বহুদিনের আকাক্সক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সমাবর্তন’ অনুষ্ঠানের। উৎসাহীদের অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন আগামী ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমাবর্তন সফল করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সেশনে উত্তীর্ণ স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং এম.ফিল ও পিএইচ.ডি পর্যায়ে প্রায় ১৮ হাজার ২৮৪ জন শিক্ষার্থী সমাবর্তনে অংশগ্রহণের জন্য তাদের রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনের কাজে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ৮৯৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের কাজ সরকারের বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ে দ্রুত সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে, যাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ক্যাম্পাস স্থাপন কার্যক্রম এগিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সব সমস্যার সমাধান নতুন ক্যাম্পাসে গিয়েই সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper