ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জলবায়ু নিয়ে কিশোরীর আন্দোলন

মোতাহার হোসেন
🕐 ৯:৩৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৩, ২০১৯

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা একটু চঞ্চল, বে-খেয়ালী, অনেকটা হুজুগেই চলে। তার অমর সৃষ্টি ‘ছুটি’ গল্পের নায়ক বা প্রধান চরিত্র ফটিক ‘চঞ্চল, হেয়ালী’ প্রকৃতির একজন বালক হিসেবে বিধৃত হয়েছে। কিন্তু, একুশ শতকে ডিজিটাল এবং বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার এই যুগে সুদূর ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের ১৬ বছর বয়সী কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পের নায়ক ফটিককে, তার চিন্তা-চেতনা, হেয়ালীপনা, চঞ্চলতাকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্ববাসীর নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

সবার দৃষ্টিতে কিশোরী গ্রেটা থানবার্গকে ‘হিরোইন বা নায়িকা’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি থেকে বিশ্ববাসীকে পরিত্রাণে সব কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী শিক্ষার্থীদের রাজপথে দাঁড় করিয়েছে সে।

গ্রেটা থানবার্গ, বয়স মাত্র ১৬ বছর। অথচ এই বয়সেই সে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের অন্যতম দাপুটে কণ্ঠস্বর। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল থাবা থেকে বিশ্বকে, এই ধরিত্রীর মানুষকে রক্ষায় ছোট এই মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে রাস্তায় নেমেছে লাখ লাখ মানুষ, রব উঠেছে ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাও, পৃথিবী বাঁচাও’।

গত ২০ সেপ্টেম্বর জতিসংঘের সদর দফতর নিউইয়র্কসহ সারাবিশ্বে মানববন্ধন হয়েছে তার আহ্বানে। ২০১৮ সালের আগস্টে নিজ দেশের সংসদ ভবনের সামনে পরিবেশ রক্ষার দাবিতে একা আন্দোলনে নামে এ সুইডিশ কিশোরী। আন্দোলনের নাম দেওয়া হয় ‘স্কুল স্ট্রাইক ফর ক্লাইমেট’। এর পরপরই সাড়া পড়ে যায় বিশ্বে। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজের লাখো শিক্ষার্থী।

গত এপ্রিলেই বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের নজরে প্রভাবশালী ১০০ জনের তালিকাতে জায়গা করে নিয়েছে এই কিশোরী। এ বছর নাম এসেছিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ীদের সম্ভাব্য তালিকাতেও। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে বলা হচ্ছে ‘নেক্সট জেনারেশন লিডার।’ এই কিশোরী যে কতটা প্রভাবশালী তার প্রমাণ মিলেছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘ জলবায়ু সামিটে আমন্ত্রণ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান নেয় গ্রেটা থানবার্গ। তবে, অধিবেশন শুরুর আগেই রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে এ কিশোরী। তার ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধের আন্দোলন।

সেদিন জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে উপস্থিত সবাই অধীর আগ্রহে ছিল, কী বলবে তাদের কিশোরী নেতা। কিন্তু, হতাশ করেনি গ্রেটা। বরাবরেই মতোই সাহসী বক্তব্য দিয়ে মাতিয়ে তোলে আন্দোলনকারীদের। গ্রেটা থানবার্গ বলে, ‘এটিই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জলবায়ু আন্দোলন। এ নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিত। কারণ, আমরা সবাই মিলেই এটি করেছি।’

তার মতে, আন্দোলনে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছে এবং এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। মূলত গ্রেটা এখন আর শুধু সুইডেনের নয়, হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্ববাসীর মুখপাত্র। বাবা-মায়ের ছোট বাড়ি নয়, এখন পৃথিবীটাই গ্রেটার ঘর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই ঘর আজ ধ্বংসের মুখে।’

শুধু চমৎকার বক্তৃতাই নয়, বিশ্বনেতাদের কাছে রীতিমতো সতর্কবার্তাও দিয়ে রেখেছে গ্রেটা থানবার্গ। বক্তব্য শেষ করার আগে তার চিৎকার করে প্রশ্ন, ‘কে আমাদের ভয় পাচ্ছে? জনগণের শক্তি এমনই। মাত্র তো শুরু। তাদের ভালো লাগুক না লাগুক, পরিবর্তন আসবেই।’ শুধু কথায় কখনো নেতা হওয়া যায় না, কাজেও প্রমাণ দেখাতে হয়- গ্রেটা সেটা ভালোভাবেই বুঝেছে। সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেতে সে প্লেন বা জাহাজে ওঠেনি, গেছে নৌকায় চড়ে। কারণ, ইঞ্জিনচালিত যানবাহনও পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ, আর তার আন্দোলন পরিবেশ রক্ষার জন্যই।

কিরিবাতি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতুর মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলহর অস্ট্রেলিয়ায় অন্তত সাড়ে তিন লাখ মানুষ যোগ দিয়েছে এ আন্দোলনে। কিছু কিছু এলাকায় স্কুলশিক্ষার্থী ও শ্রমিকদেরও আন্দোলনে নামতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আন্দোলন ছড়িয়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকাতেও। ঘানায় শিক্ষার্থীরা রাজধানী আকরা অভিমুখে পদযাত্রা করেছে। ভারত-থাইল্যান্ডে ‘ডাই-ইন’ (মৃতের অভিনয়) করেছে আন্দোলনকারীরা।

জার্মানির পাঁচ শতাধিক শহরে পথে নেমেছে জলবায়ু আন্দোলনকারীরা। দেশটির সরকার ইতোমধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাতে ১০০ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে। আর যুক্তরাজ্যের চারটি দেশেই লাখ লাখ মানুষ জলবায়ু আন্দোলনে শামিল হয়েছে।

‘আমি কতটা কাতর ও ক্ষুব্ধ, তাতে কিছু যায় আসে না- আমি তা বিশ্বাস করতে চাই না। যদি আপনি পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারেন, কিন্তু এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন, তখন আপনি অশুভ হয়ে যাবেন এবং আমি তা বিশ্বাস করতে অস্বীকার করব।’ বক্তব্যকে আরও জোরদার করতে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে একের পর এক বিপজ্জনক ঘটনার তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়েছে কিশোরী গ্রেটা।

‘আপনারা আমাদের ব্যর্থ করে দিচ্ছেন, কিন্তু ছোটরা আপনাদের প্রতারণা বুঝতে শুরু করেছে’- বলল এ কিশোরী। এই সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী জানায়, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাদের ওপর নজর রাখছে। যদি আপনারা আমাদের ব্যর্থ করে দিতে চান, তবে আমরা আপনাদের কখনও ক্ষমা করব না।’ গ্রেটার পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিশ্বের সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ এবং দেশের আপামর জনগণের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। আশা করছি গ্রেটার আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির মধ্যদিয়ে জলবায়ু ঝুঁকি থেকে বিশ্ব বাঁচবে, আমরা বাঁচব।

মোতাহার হোসেন : কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

 
Electronic Paper