লেজুড় ছাত্ররাজনীতি চাই না
মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
🕐 ৯:১৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০১৯
বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বুয়েট ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একদল নেতা-কর্মী। ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা তাকে আরেকটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থক সন্দেহে মর্মান্তিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এর ফলে দেশব্যাপী নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় বইছে। এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১০ দফা দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের এই ১০ দফা দাবির অন্যতম হলো খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত খুনিদের বুয়েট থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা, বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা সাড়া ফেলেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও। বিবিসি, রয়টার্স, ভয়েস অব আমেরিকা, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস, আল-জাজিরা, গালফ নিউজসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বুয়েটের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলাদেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর। প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিয়ে।
৯০ এর পর থেকে ছাত্ররাজনীতির কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, দলাদলি-গ্রুপিং, মারামারি, নির্যাতন, খুন-হত্যা, টেন্ডারবাজি, ক্যাম্পাস-হল দখলসহ নানা অপকর্মের চিত্র। চোখ মেলে তাকালেই ছাত্ররাজনীতির অসংখ্য খারাপ দিক বা উদাহরণ চোখের সামনে মিলবে। ৯০-এর পর ছাত্ররাজনীতির ভালো দিক খুঁজে বের করতে হলে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
অনেকে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা এমনকি সর্বশেষ ৯০ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছাত্ররাজনীতির ফসল বলে দাবি করেন এবং এসব অর্জনকে উদাহরণ হিসেবে এনে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে কথা বলেন। আমি তাদের বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন এমন সব অর্জনে ছাত্রদের ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু তা ছাত্ররাজনীতির কারণে নয় বরং তা সফল ছাত্র আন্দোলনের কারণে। মনে রাখতে হবে, ছাত্ররাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলন এক কথা নয়।
বর্তমানে ছাত্ররা রাজনীতি করে দলীয় আদর্শের ভিত্তিতে এবং দলীয় স্বার্থে। অথচ ছাত্রদের রাজনীতি ও আন্দোলন হওয়া প্রয়োজন দেশের কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দল মুষ্টিমেয়র আর দেশ সবার। দলীয় আদর্শ দলভেদে পার্থক্য হতে পারে, এমনকি বিপরীতমুখীও হতে পার। কিন্তু দেশের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবতা সবার। ছাত্ররা যখন দলীয় আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তখন রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা মানবতার প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তি কিংবা দলীয় প্রয়োজনই তার কাছে বড় হয়ে দাঁড়ায়। অন্য সব দিক বাদ দিলেও দলীয় আদর্শ ছাত্রদের মাঝে বিভক্তিই বাড়ায় কেবল।
প্রশ্ন উঠতে পারে ছাত্র রাজনীতি না থাকলে দেশের প্রয়োজনে ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হবে কীভাবে? ছাত্রদের নেতৃত্ব তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রসংসদই যথেষ্ট। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে ছাত্রসংসদগুলো সচল রাখার। নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিতে হবে। সেখানে থাকবে না বাহিরের দলীয় কোনো নিয়ন্ত্রণ। ছাত্ররাই তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্ররাজনীতি ও আন্দোলন করবে। এভাবেই ছাত্রদের মাঝে ফুটে উঠবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বগুণ। তখন রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় তাহলে সেখানেও তারা সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
আমরা দেখেছি, প্রয়োজনেই আন্দোলন গড়ে ওঠে। কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এবং কোনো সংগঠিত শক্তির সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া কেবল নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ সংগঠিত হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে এবং আন্দোলন থেকেই নেতৃত্বের সৃষ্টি হতে পারে। তার উদাহরণ আমরা দেখি কানসাট, আইড়ল বিল কিংবা ফুলবাড়িতে। আরও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে অতি সাম্প্রতিককালের কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা গণতান্ত্রিক আন্দোলন সবই ছিল আমাদের জাতীয় সত্তার প্রয়োজনে, কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রয়োজনে নয়। এসব আন্দোলনে সমগ্র জাতির সংশ্লিষ্টতা ছিল বলেই তা সফল হয়েছে। কিন্তু জাতীয় প্রয়োজনে ছাত্রদের দলীয় বিভক্তি অনেক সময় বড় আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করে এমনকি ব্যর্থও করে দেয়।
এর সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য প্রমাণ আমরা দেখি নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০০৬ এর সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে। স্বৈরাচার এরশাদের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দেশের প্রায় প্রতিটি দলই যার যার অবস্থান থেকে পৃথকভাবে সোচ্চার আন্দোলন করেছিল দীর্ঘ প্রায় নয় বছর যাবৎ। তবুও সে আন্দোলন সফল হয়নি। সামরিক শাসক এরশাদকে হটানো সম্ভব হয়নি। যখনই সব ছাত্র সংগঠন দলীয় সংকীর্ণ আদর্শের বাইরে এসে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে একতাবন্ধ হতে পেরেছে তখনই সাফল্য এসেছে।
২০০৬ এর সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ছাত্রদের বিভক্তি। ছাত্র সংগঠনগুলো দলীয় লেজুড়ভিত্তিক হওয়ায় সংস্কার আন্দোলনকে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থের পরিবর্তে নিজেদের দলীয় স্বার্থের গণ্ডির মধ্যে দেখেছে। ফলে এ সংস্কারগুলো রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও আন্দোলনের সার্বজনীনতা না থাকায় এ আন্দোলনে সাফল্য আসেনি।
দেশের বহুধাবিভক্ত সংঘাতময় রাজনীতিতে বর্তমান ধারার ছাত্ররাজনীতি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আর কোনো গণআন্দোলনই ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সফল হবে না এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের নতুন করে ভেবে দেখতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা।
মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
কলাম লেখক